বাঁধন খোলার সাধনেই মত্ত শহর

শুয়ে থাকার ভঙ্গিতে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়েছেন চালক। আড়চোখে দেখছেন রাস্তা। ওই অবস্থাতেই কোনও মতে তাঁর হাত পৌঁছচ্ছে স্টিয়ারিংয়ে। সিট বেল্ট পরার কোনও বালাই নেই।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৪২
Share:

সিট বেল্ট ছাড়াই গাড়িতে সওয়ার চালকেরা। প্রশ্ন করতেই অবশ্য তড়িঘড়ি সিটবেল্ট বেঁধে নিলেন তাঁদের কেউ কেউ। হেদুয়া এলাকায় বিপ্রজিৎ মল্লিকশুক্রবার। ছবি: শৌভিক দে

শুয়ে থাকার ভঙ্গিতে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়েছেন চালক। আড়চোখে দেখছেন রাস্তা। ওই অবস্থাতেই কোনও মতে তাঁর হাত পৌঁছচ্ছে স্টিয়ারিংয়ে। সিট বেল্ট পরার কোনও বালাই নেই। খন্না মোড়ের কাছে সিগন্যালে যখন ট্যাক্সিটি এসে দাঁড়াল, চালক সন্তোষ সিংহ বললেন, ‘‘খাওয়াটা বড্ড বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই একটু রিল্যাক্সে চালাচ্ছি।’’

Advertisement

কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীকে কড়া চোখে তাকাতে দেখে এর পরে আড়মোড়া ভেঙে অনিচ্ছায় সিট বেল্ট পরলেন। তা-ও অল্প সময়ের জন্য। রাস্তা পেরোতেই ফের তিনি বেপরোয়া। আলগা করে দিলেন সিট বেল্ট। মুখের ভাবখানা দেখে মনে হল, সিট বেল্ট না বেঁধে বিরাট কৃতিত্বের কোনও কাজ করেছেন। যেন ওটা নিজের নয়, পরতে হয়েছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সুরক্ষার জন্য।

হাজারো প্রচার, দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা— কিছুতেই কিছু কাজ হচ্ছে না। হুঁশ ফিরছে না শহরবাসীর। দিনের বেশির ভাগ সময়ে বড় সিগন্যালগুলিতে লোক দেখানো ভাবে সিট বেল্ট পরলেও বাকি সময়টা চালকের শরীর থাকছে অরক্ষিতই। চালকের মতো হুঁশ নেই পাশে বসা যাত্রীরও। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা সিট বেল্ট ব্যবহার করছেন না। পিছনের আসনের যাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ। তাঁদের অনেকে জানেনই না যে, সিট বেল্ট তাঁদের জন্যও।

Advertisement

হেদুয়ার রাস্তায় পরিবারের সঙ্গে গাড়িতে যাচ্ছিলেন বিপ্রজিৎ মল্লিক। তিনি নিজে তো সিট বেল্ট পরেনইনি, পিছনের আসনে বসা গাড়ির বাকি যাত্রীরাও অরক্ষিত। এ ভাবে গাড়ি চালানোর কারণ? বিপ্রজিৎ বলেন, ‘‘ভুলে গিয়েছি। সব সময়ে মনে থাকে না। পরে নিচ্ছি।’’ পিছনের সিটে বসেছিলেন ‌‌সোহানা সরকার। তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আমাদেরও পরতে হয় নাকি? শুনিনি তো!’’ এর পরে বিপ্রজিৎকে সোহানা বলেন, ‘‘দাদা এগুলো কাজ করে? পরা যায়?’’

সিট বেল্ট ছাড়া স্কুলপড়ুয়াদের গাড়িও চলছে বেপরোয়া ভাবে। এ দৃশ্য এ দিন দেখা গেল শ্যামবাজারে। গাড়ির চালক সুশান্ত কয়াল বলেন, ‘‘বাচ্চাদের নিয়ে চালাচ্ছি। নিশ্চয়ই সাবধানে চালাব। তবু বলছেন যখন, পরে নিচ্ছি।’’ পুলিশ ধরলে কী হত? সুশান্তের জবাব, ‘‘তখন

বুঝে নিতাম।’’ এর পরে আর কোনও কথা বলার আগেই গাড়ি ছুটিয়ে দেন তিনি। হঠাৎ গতিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পাশে বসা স্কুলপড়ুয়া। এর পরেই চালক গাড়ি ছুটিয়ে তিনি বেরিয়ে যান।

দক্ষিণ কলকাতার চিত্রটাও একই। এ দিন দুপুরে ভবানীপুরের রাস্তায় ছোট লরি চালিয়ে যাচ্ছিলেন বিজয় সর্দার। মালবোঝাই গাড়িতে চালকের পাশের আসেন দু’জন। কেউই যে সিট বেল্ট ব্যবহার করছেন না, বলাই বাহুল্য। উল্টে বললেন, ‘‘আমাদের জন্য সব ছাড় আছে। পুলিশ আমাদের আটকাবে?’’ চেতলার কাছে গাড়িতে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। গাড়ি থামিয়ে সিট বেল্ট নেই কেন প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘‘উত্তর তো আপনাকে দেব না। পুলিশ যদি ধরে, তখন বুঝে নেব।’’ তবে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সিট বেল্ট বাঁধতে দেখা

গেল তাঁকে।

পুলিশ অবশ্য জানাচ্ছে, সিট বেল্ট নিয়ে কড়া আইন রয়েছে। সিট বেল্ট না পরলে মোটর ভেহিক্‌ল আইনের ১৩৮ (৩) ধারায় মামলা করা যায়। ১৭৭ নম্বর ধারায় জরিমানা দিতে হয় ১০০ টাকা। তবে গাড়িতে যদি সিট বেল্টই না থাকে, সে ক্ষেত্রে ১২৫ (এ) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এ ক্ষেত্রেও জরিমানা ওই ১০০

টাকাই। তবু চালকেরা সতর্ক হচ্ছেন না কেন? লালবাজারের এক ট্র্যাফিক-কর্তা বলেন, ‘‘আসলে এখনও সিসিটিভি দেখে সিট বেল্ট না পরার জন্য কেস করা যায় না। ম্যানুয়ালি করতে হয়। তারই সুযোগ নেন অনেক চালক।’’ ওই আধিকারিকই জানাচ্ছেন, অনেকে সিট বেল্ট পিঠের পিছনে ফেলে রাখেন। পুলিশ দেখলেই পরে নেন। কিন্তু বিপদ যে পুলিশে নয় দুর্ঘটনায়, এটা অনেকেই বোঝেন না।

মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবও বলছেন, ‘‘কোনও কিছুরই পরোয়া না করা তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘আমার কিছু হবে না’ গোছের এক অমূলক বিশ্বাস। খারাপ ঘটনা এক বার ঘটে গেলে যে আর কিছু করার থাকবে না, এই বোধ জন্মানোটা খুব দরকার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন