Pedestrians

গাড়ি থামে না স্টপ লাইনে, রাস্তা পেরোনোর সময়ও নয় পর্যাপ্ত, বহু প্রশ্ন তুলে দিল সৌরনীলের মৃত্যু

শহরের বেশির ভাগ সিগন্যাল পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত সময় খোলা থাকে না বলে অভিযোগ। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পথচারী রাস্তার মাঝামাঝি আসার সময়েই খুলে গিয়েছে গাড়ি যাওয়ার সিগন্যাল।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ০৫:১২
Share:

মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরেও ফেরেনি হুঁশ। বেহালা চৌরাস্তায়। —ফাইল চিত্র।

কতটা দ্রুত হাঁটলে তবে নিরাপদে রাস্তা পেরোনো সম্ভব? গত শুক্রবার বেহালা চৌরাস্তার কাছে লরির ধাক্কায় এক স্কুলপড়ুয়ার মৃত্যুর পরে দোষ কার, তা নিয়ে দায় ঠেলাঠেলির মধ্যেই এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ, শহরের বেশির ভাগ সিগন্যাল পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত সময় খোলা থাকে না বলে অভিযোগ। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পথচারী রাস্তার মাঝামাঝি আসার সময়েই খুলে গিয়েছে গাড়ি যাওয়ার সিগন্যাল। তখন তিনি বুঝেই উঠতে পারেন না, বাকি রাস্তা পেরোবেন কী করে? গাড়ি থামা পর্যন্ত দাঁড়াবেনই বা কোথায়? অভিযোগ ওঠে, গাড়ি ‘স্টপ লাইন’ না মেনেই দাঁড়িয়ে পড়ার জেরে আরও সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে রাস্তা পারাপারের পরিসর।

Advertisement

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ নিয়ে অতীতে একাধিক আলোচনা হয়েছে। মূলত বয়স্ক এবং শিশুদের নিয়ে যাতায়াত করার সময়ে সমস্যার কথা ভেবে পথচারীদের সুবিধার্থে সিগন্যালের সময় বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। এমনকি, সিগন্যালের কাছে আইল্যান্ড তৈরি করে অপেক্ষা করার জায়গা করে দেওয়ারও কথা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ। বেহালার ঘটনার পরে আইল্যান্ড তৈরির প্রসঙ্গ নিয়ে ফের নড়াচড়া শুরু হলেও তা বাস্তবায়িত হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। আরও প্রশ্ন, কম সময় পাওয়ার জেরেই কি ছেলের হাত ধরে দ্রুত রাস্তা পেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন মৃত ছাত্রের বাবা?

ভুক্তভোগীদের আর একটি অংশের আবার অভিযোগ, গাড়ির গতি বাড়াতে পুলিশের তরফে বহু জায়গাতেই সিগন্যাল লাল থেকে সরাসরি সবুজ করে দেওয়া হচ্ছে। দুইয়ের মাঝে বেশ কয়েক বার লাল সিগন্যাল জ্বলে বন্ধ হওয়ার কথা। যাকে ‘অ্যাম্বার টাইম’ বলা হয়। সেই সময়টাতেই মূলত পথচারী এবং গাড়ির চালকেরা সতর্ক হয়ে যান। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শহরে গাড়ির গতি বাড়াতে ওই অ্যাম্বার টাইম তুলে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। বেহালায় ছাত্র-মৃত্যুর দিনেও তা-ই হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Advertisement

ওই ঘটনার পরে শহরে ঘুরে দেখা গেল, বড় রাস্তার বেশ কিছু অংশ রয়েছে, যেগুলি ৩০ থেকে ৪০ মিটার চওড়া। যেখান দিয়ে দু’লেনে গাড়ি চলে। কোনও পথচারীকে ওই রাস্তা পেরোতে হলে এক লেন পার হয়ে পরের লেন পেরোতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই সময় পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, ই এম বাইপাসের কাছে পাটুলি মোড়ে রাস্তা প্রায় ৩০ মিটার চওড়া। সেখানেই এক বয়স্ককে দেখা গেল, রাস্তার মাঝামাঝি পৌঁছে আর এগোতে পারছেন না। গাড়ি না থামা পর্যন্ত তিনি থমকে রয়েছেন। বৃদ্ধ বলেন, ‘‘পেরোব কী করে? রাস্তার মাঝামাঝি আসার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যাল সবুজ হয়ে গাড়ি ছুটতে শুরু করল। তবে আরও কিছু ক্ষণ সিগন্যাল লাল থাকলেও পেরোতে পারতাম বলে মনে হয় না। কারণ, গাড়ির যেখানে থামার কথা, তার চেয়েও অনেকটা এগিয়ে এসে রাস্তা পেরোনোর জায়গাতেই প্রায় দাঁড়িয়েছে।’’

সেখানেই একটি চায়ের দোকানে বসা এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘বহু লোকেরই এখানে সমস্যা হয়। অঙ্ক কষে দেখলে বোঝা যাবে, কোনও বয়স্কের হাঁটার গতি যদি ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার হয়, তা হলে ওই রাস্তা পার হতে তাঁর ২০ সেকেন্ড সময় লাগার কথা। কিন্তু এই সিগন্যাল পথচারীদের জন্য খোলা থাকে মাত্র ১০ সেকেন্ড।’’ একই অবস্থা ই এম বাইপাসের কাদাপাড়া মোড়ে। কোনও মতে রাস্তার এক দিকের লেন পার করে ডিভাইডার পর্যন্ত পৌঁছে এক মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল দীর্ঘ ক্ষণ। দু’বার পথচারীদের সিগন্যাল সবুজ হলেও পার হওয়ার সাহস দেখাতে পারলেন না তিনি। কারণ, প্রতিবারই গাড়ি এসে থামল তাঁর প্রায় যাতায়াতের পথে। অথচ, সেখানেও সিগন্যাল খোলা থাকে মাত্র ১০ সেকেন্ড। পার্ক স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, হাজরা মোড়ের কাছেও একই রকম অবস্থা।

লালবাজার সূত্রের খবর, ট্র্যাফিক বিভাগের প্ল্যানিং অ্যান্ড সার্ভে শাখা ট্র্যাফিক গার্ডের সঙ্গে বিভিন্ন সিগন্যালের সময় পর্যালোচনা করে। ২০১৮ সালের ট্র্যাফিক পুলিশ রিভিউ বৈঠকে সিগন্যালে পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত সময় রাখা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। সেখানে ঠিক হয়, পথচারী, যানবাহনের চাপ এবং সংখ্যার উপরে ভিত্তি করে বিভিন্ন ট্র্যাফিক সিগন্যাল খোলা-বন্ধের সময় নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে প্রায় সব রাস্তাতেই পথচারীদের জন্য গড়ে ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড করে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গেই স্টপ লাইন পেরিয়ে দাঁড়ানো গাড়ির ক্ষেত্রেও তেমন কড়াকড়ি চোখে পড়ে না বলে অভিযোগ। পুলিশ এ ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের মোটর ভেহিক্‌লস আইনে পদক্ষেপ করতে পারে। এর জন্য প্রথম বার গাড়িচালকের ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। পরে একই অপরাধে জরিমানা হতে পারে ১৫০০ টাকা করে। কিন্তু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নিয়ে এত অভিযোগ কেন? কলকাতার নগরপাল বিনীত গোয়েল বলেন, ‘‘কড়া ভাবে সব দেখা হচ্ছে। যা যা গাফিলতির প্রশ্ন উঠছে, দ্রুত সমাধান করে ফেলা হবে।’’ কিন্তু বড় দুর্ঘটনা ঘটার পরে এমন আশ্বাস দেওয়ার বদলে কেন আগেই পদক্ষেপ করা হয় না? স্পষ্ট উত্তর মেলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন