বিচারাধীন বন্দির মৃত্যু পিজি-তে, রহস্য

গ্রেফতার হওয়ার পরে এক রাত থানার লকআপে। তার পরে ন’দিন প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখান থেকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে এক রাত। কিন্তু পরদিন লালবাজার থেকে আদালত হয়ে জেলে ঢোকার মুখেই শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে পাঠানো হল এসএসকেএম হাসপাতালে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১৬
Share:

ফরদিন খান। (ডান দিকে) মা ইনতিয়াজ বেগম।

গ্রেফতার হওয়ার পরে এক রাত থানার লকআপে। তার পরে ন’দিন প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখান থেকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে এক রাত। কিন্তু পরদিন লালবাজার থেকে আদালত হয়ে জেলে ঢোকার মুখেই শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে পাঠানো হল এসএসকেএম হাসপাতালে। শুক্রবার রাতে সেখানে ফরদিন খান ওরফে ইজাজ (২০) নামে ওই বন্দির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রহস্য দানা বেঁধেছে। ঘটনাটি শুনে শুক্রবার রাতে হাসপাতালে ক্ষোভ দেখান মৃতের পরিজনেরা। তাঁদের সরাতে লাঠিচার্জ করতে হয় পুলিশকে।

Advertisement

ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত ইজাজকে পুলিশ ১০ দিনে দু’দফায় হেফাজতে পেয়েছিল। প্রথমে ৬ নভেম্বর নিউ আলিপুর থানা, তার পরে ১৬ নভেম্বর লালবাজারের ছিনতাই দমন শাখা। একবালপুরের ডাক্তার সুধীর বসু রোডের বাসিন্দা ওই যুবকের পরিবারের অভিযোগ, লালবাজারে বুধবার রাতে পুলিশ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছিল, যার ফলেই ইজাজের মৃত্যু হয়েছে। ইজাজের মা ইনতিয়াজ বেগম বলেন, ‘‘১৩ তারিখ প্রেসিডেন্সি জেলে ছেলেকে দিব্যি সুস্থ দেখে এসেছিলাম। চার দিনের মধ্যেই কী এমন হল যে, ইজাজ মারা গেল? লালবাজারের লকআপে পুলিশের মারেই আমার ছেলে মারা গিয়েছে।’’

গোয়েন্দা বিভাগের তরফে অবশ্য ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করা হয়েছে, ইজাজ মাদকাসক্ত ছিল এবং নেশার ফলে তার ফুসফুস, লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায় আর শেষমেশ সে মারা যায়। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেও সেই কথাই জানা গিয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য ইজাজের মৃত্যুকে ‘মর্মান্তিক ঘটনা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

Advertisement

এসএসকেএম হাসপাতালের একটি সূত্রে খবর, ময়না-তদন্তের সময়ে ইজাজের দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। লালবাজারের লকআপে মারধর না করা হলে সেই আঘাত কোথা থেকে এল? পুলিশ অবশ্য আঘাতের কথা স্বীকারই করেনি। লালবাজার উল্টে দাবি করেছে, মৃতদেহের সুরতহালের সময়ে দেহে আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। কিন্তু ইজাজের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিজনেরা এসএসকেএমের সামনে পুলিশের বিরুদ্ধে পিটিয়ে মারার অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ইজাজের মৃত্যুর খবর পেয়েই এক বার শুক্রবার রাতে, পরে শনিবার সকালেও। ক্ষোভ ও উত্তেজনার পারদ এতটাই চড়েছিল যে, তা সামলাতে শনিবার বেলা ১১টা নাগাদ হাসপাতালে ছুটে যেতে হয় রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। ঘণ্টা খানেক থাকেন তিনি। মন্ত্রী ফিরহাদের কথায়, ‘‘খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়েই এসেছি। ঠিক কী কারণে ইজাজের মৃত্যু হয়েছে, তার তদন্ত হবে।’’ বিচারাধীন বন্দির মৃত্যু বলে ওই ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত হবে। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত মৃতের বাড়ির লোকজন পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও লিখিত অভিযোগ দায়ের করেননি। শুক্রবার রাতে হাসপাতালে গণ্ডগোলের ঘটনায় ভবানীপুর থানার পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা রুজু করেছে। তবে কেউ গ্রেফতার হয়নি।

হিসেবমতো বিচারবিভাগীয় হেফাজত বা জেল হেফাজতে ইজাজের মৃত্যু হয়েছে। কারণ, লালবাজারের গোয়েন্দারা ১৬ তারিখ তাকে নিজেদের হেফাজতে পাওয়ার পরদিনই আদালতে হাজির করান। আদালত তাকে জেলে পাঠায়। কিন্তু জেলে তাকে থাকতে হয়নি। তার আগেই হাসপাতালে ভর্তি হয়।

গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, ইজাজ বহু দিন ধরেই মাদকাসতক্ত। ইজাজকে তারাতলা থানার একটি মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে সাত দিনের জন্য হেফাজতে পান গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্সি জেল থেকে লালবাজারে নিয়ে আসার পরেই বোঝা যায়, ওই যুবকের আচরণ স্বাভাবিক নয়। পরদিন তার উইথড্রয়াল সিনড্রোম দেখা যায়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তখন ইজাজকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। তখন গোয়েন্দা অফিসারেরা ঠিক করেন, সে দিনই আদালতে ইজাজকে হাজির করিয়ে জানাতে হবে, তাকে আর পুলিশি হেফাজতে রাখার দরকার নেই।

সাধারণত কোনও অভিযুক্তকে যত দিন হেফাজতে পাওয়া গিয়েছে, তত দিনের জন্যই রাখা হয়। প্রয়োজনে আদালতে আবেদন করা হয়, পুলিশি হেফাজতে তাকে রাখার মেয়াদ আরও বাড়াতে। এ ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টো। কলকাতা পুলিশেরই এক কর্তার কথায়, ‘‘ধরে নেওয়া গেল, লালবাজারে ওই যুবকের উপরে কোনও অত্যাচার করা হয়নি। কিন্তু চিকিৎসক ওর শারীরিক অবস্থা খারাপ বলার পরে গোয়েন্দা বিভাগেরই তো ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত ছিল। তা না করে আদালতে নিয়ে গেল। আসলে পুলিশ দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছিল।’’ ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম কমিশনার (অপরাধদমন) বিশাল গর্গের বক্তব্য, ‘‘অনেক প্রশ্নই উঠছে। সবই আমরা তদন্ত করে দেখছি।’’

বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢোকানোর সময়ে জেলকর্মীদের সন্দেহ হওয়ায় তাঁরা ইজাজকে জেলের চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যান। ওই চিকিৎসকেরাই তাকে জেল হাসপাতালের বদলে অন্য জায়গায় ‘রেফার’ করেন।

পেশায় গাড়িচালক সরফরাজ খান ও ইমতিয়াজ বেগমের একমাত্র ছেলে ইজাজ। তার পরিবারের দাবি, ২০১৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করে সে টুকটাক গাড়ি চালানোর কাজ শিখছিল। বাড়ির লোকজন জানাচ্ছেন, ৬ নভেম্বর সকালে ইজাজকে তার বন্ধু আমন ডেকে নিয়ে যায়। তার পরে সে বাড়ি না ফেরায় আত্মীয়েরা খোঁজাখুঁজি করে জানতে পারেন, ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ইজাজকে।

পুলিশের দাবি, গত ৬ নভেম্বর তারাতলা টাঁকশালের কাছ থেকে ইজাজকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিন চলন্ত বাস থেকে একটি মোবাইল ছিনতাই করে পালানোর সময়ে তাকে পাকড়াও করে ট্র্যাফিক পুলিশ। নিউ আলিপুর থানার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে। ছিনতাই হওয়া জিনিস উদ্ধার হওয়ায় ইজাজকে হেফাজতে রাখার দরকার হয়নি এবং পরদিন তাকে আদালতে হাজির করিয়ে বিচারককে সেই কথাই জানানো হয় বলে বক্তব্য পুলিশের। তার পরেই প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন