নামে বিভ্রান্তি, পাভলভ থেকে ফিরতে ৩ বছর

তিনি যে সায়রা খাতুন, গীতা কুণ্ডু নন, তা প্রমাণ করে ঘরে ফিরতে সময় লাগল তিন-তিনটে বছর। সুস্থ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই তিনটে বছর তাঁর কাটল মানসিক হাসপাতালের গরাদের আড়ালে। পাভলভ মানসিক হাসপাতালের এই ঘটনাই আরও এক বার প্রমাণ করে দিল, মনোরোগীদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর প্রক্রিয়া এখনও কী ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০১:১৮
Share:

বাড়ি ফেরার পরে সায়রা খাতুন। নিজস্ব চিত্র

তিনি যে সায়রা খাতুন, গীতা কুণ্ডু নন, তা প্রমাণ করে ঘরে ফিরতে সময় লাগল তিন-তিনটে বছর। সুস্থ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই তিনটে বছর তাঁর কাটল মানসিক হাসপাতালের গরাদের আড়ালে। পাভলভ মানসিক হাসপাতালের এই ঘটনাই আরও এক বার প্রমাণ করে দিল, মনোরোগীদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর প্রক্রিয়া এখনও কী ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার।

Advertisement

২০১২ সালে দক্ষিণ কলকাতার এক ফুটপাথ থেকে বছর পঁচিশের এক তরুণীকে উদ্ধার করে পুলিশ। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই তরুণীর ঠাঁই হয় পাভলভে। টানা দু’বছর চিকিৎসার পরে চিকিৎসকেরা তাঁকে সুস্থ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু সুস্থ তো হলেন, যাবেন কোথায়? কার কাছে? একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাসপাতাল চত্বরে যে লন্ড্রি চালায়, সেখানেই কাজ শুরু করেন ওই তরুণী। সঙ্গে শুরু হয় বাড়ি ফেরার জন্য লড়াই।

পরের বৃত্তান্তটা শোনালেন ওই সংগঠনের কর্মী শুক্লা দাসবড়ুয়া এবং ঈপ্সিতা মুখোপাধ্যায়। তাঁরা জানান, মনোরোগীদের মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য তাঁরা যে প্রকল্পগুলি চালান, সুস্থ হওয়ার পরে হাসপাতালে সেগুলিতে নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করেন ওই তরুণী। তাঁরা ওঁকে গীতা নামেই চিনতেন। ক্রমে গীতা জানান, ওটা তাঁর নাম নয়। তাঁর নাম সায়রা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘটকপুকুরের কাছে তাঁর বাড়ি। সেখানেই থাকে তাঁর গোটা পরিবার। তা হলে পুলিশ কী ভাবে তাঁকে গীতা নামে ভর্তি করল? সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর তিনি দিতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকেও কোনও তথ্য বেরিয়ে আসেনি। থানা থেকে জানানো হয়েছে, যে অফিসার ওই তরুণীকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে মানসিক হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে গিয়েছেন। তাই তাঁদের পক্ষে এ নিয়ে কিছু জানানো সম্ভব নয়। কোথায় বদলি হয়েছেন? সেই প্রশ্নেরও কোনও সদুত্তর মেলেনি। অতঃপর হাসপাতালের খাতায় গীতা হয়েই দিন কাটাচ্ছিলেন সায়রা। ওই সংগঠনের কর্মীদের কাছে নিজের পূর্ব জীবনের কথা বলতে বলতেই নিজের ঠিকানাও জানান সায়রা। সংগঠনের তরফে সেখানে যোগাযোগ করে জানা যায়, সেই পরিবারের মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে ২০১২ সাল থেকে নিখোঁজ। সায়রার ছবি দেখানো হয় তাঁদের। সঙ্গে সঙ্গে কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায় সেই পরিবারে।

Advertisement

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। কিন্তু সায়রার ভোটার কার্ড কিংবা আধার কার্ড নেই। নেই অন্য কোনও সচিত্র পরিচয়পত্রও। হাসপাতালের তরফে জানানো হয়, এই পরিস্থিতিতে তাঁদের পক্ষে ওই তরুণীকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন: ‘অজানা জ্বর’ লিখে দায়িত্ব সারল সরকারি হাসপাতাল

প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি স্রেফ একটা নামের ভুলের জেরেই এক জন সুস্থ মানুষ তাঁর বাকি জীবনটা মানসিক হাসপাতালেই থেকে যাবেন? এর পরে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। এর পরে আদালতে হলফনামা পেশ করে তাঁরা জানান, পাভলভে ভর্তি থাকা গীতা আসলে তাঁদের পরিবারের মেয়ে সায়রা। মেয়েকে ফেরত পাওয়ার আর্জি জানান তাঁরা। হলফনামা পেয়ে ছুটি দিতে আপত্তি করেনি হাসপাতালও। পুলিশকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, এই সব ক্ষেত্রে রোগী নিজে যা নাম বলেন, সেটাই লেখা হয়। এক জন মানসিক রোগিণী যদি তাঁর নাম ভুল বলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের কিছু করার থাকে না। এমন ঘটনা বিচ্ছিন্ন বলেই তাঁদের দাবি। প্রশ্ন উঠেছে, এই সব ক্ষেত্রে যেখানে সুস্থ হয়ে উঠে কেউ নিজের পরিচয় জানাতে পারছেন, সেখানে তাঁকে বাড়ি ফেরত পাঠানোটা কেন লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকবে? কেন স্বাস্থ্য দফতর উদ্যোগী হয়ে আইনের সাহায্য নিয়ে তাঁদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করবে না? দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘হাসপাতালের সেই পরিকাঠামোই নেই। এই কারণেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ হওয়াটা জরুরি। সেই পথেই এগোচ্ছি আমরা। তবে নিয়মকানুন আরও সহজ হওয়া জরুরি।’’ পাভলভ কর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরাও চান এই প্রক্রিয়া আরও মসৃণ হোক।

মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায়ও বলেন, ‘‘মনোরোগীদের হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার প্রক্রিয়াটাই নানা রকমের হয়রানিতে ভরা। এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট নীতি নেই। যতক্ষণ না আরও স্বচ্ছতা আসছে এ বিষয়ে, ততক্ষণ হাসপাতালগুলিতে উপচে পড়া ভিড় কমানো সম্ভব হবে না।’’

আর সায়রা? তিনি বলছেন, ‘‘আমি তো বাড়ি ফিরতে পারলাম। আমার মতো আর কেউ অন্য কোথাও অন্য পরিচয়ে আটকে নেই তো?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন