বাটালির নিখুঁত টানে রিসোল-ই এখন ‘আসল’

ই এম বাইপাস লাগোয়া পরপর ঝুপড়িঘরের একটিতে তক্তপোষে রাখা গাড়ির টায়ার। মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগে ছোট বাটালি দিয়ে তার উপরে খোদাই করছেন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়। পুরনো চাকার মোটা মসৃণ রিসোলে অবিকল ফুটে উঠছে বিভিন্ন সংস্থার টায়ারের নকশা।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৬ ০১:০৯
Share:

এ ভাবেই ভোল বদল। — বিশ্বনাথ বণিক

ই এম বাইপাস লাগোয়া পরপর ঝুপড়িঘরের একটিতে তক্তপোষে রাখা গাড়ির টায়ার। মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগে ছোট বাটালি দিয়ে তার উপরে খোদাই করছেন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়। পুরনো চাকার মোটা মসৃণ রিসোলে অবিকল ফুটে উঠছে বিভিন্ন সংস্থার টায়ারের নকশা।

Advertisement

ছোট্ট ঝুপড়িটাই কারখানা। দরজার পাশে টায়ারের স্তূপ। ঝিরঝির বৃষ্টির দুপুরে গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে। দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম, দাদা, একটু শুনবেন? গলার আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন প্রৌঢ়। নাম বললেন, আরশাদ (পরিবর্তিত)। ‘‘কী গাড়ি আপনার?’’ বললাম, চারটে হলুদ ট্যাক্সি আর দুটো মারুতি ডিজায়ার। মারুতিগুলো ক্যাব হিসেবে ভাড়ায় চলছে। হাতের টায়ার তক্তপোষের পাশে সরিয়ে এ বার উঠে বসলেন আরশাদ। হাতের বাটালি নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘‘রেডি আছে। পাবেন। এক একটা হাজার টাকা।’’ বললাম, আজ নেব না। আজ মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে যাব। বাবাকে দেখাতে হবে। সব গাড়িই বাবার। উনি ছবি দেখে রাজি হলে কিনে নিয়ে যাব।

আরশাদ বলেন, ‘‘বসুন। এখানে অবিকল কোম্পানির মতন তৈরি করা হয়। পুলিশের বাবাও দূরবীন দিয়ে দেখলে ধরতে পারবে না। এমন নিঁখুত নকশা!’’ ঝুপড়ির মাচা থেকে এ বার একটি সংস্থার আসল চাকা নামিয়ে আনেন প্রৌঢ়। পাশে রাখেন নিজের তৈরি রিসোল। ‘‘দেখুন। আপনি তো অনেক দিন ব্যবসা করছেন! কিছু বুঝতে পারছেন?’’ সত্যিই তাই। বাটালির আঁচড় এতই নিপুণ যে, সাদা চোখে ধরার উপায় নেই ওই টায়ার আসল না রিসোল!

Advertisement

‘‘আরে দাদা, এখানে শুধু মোটরসাইকেল, ট্যাক্সিওয়ালা, বাসের মালিকরা আসেন না! ঘণ্টাখানেক বসুন। দেখবেন বড় বড় গাড়িওয়ালারা এসে রিসোল নিয়ে যাবে। স্করপিও মারুতি, নানা গাড়ি। কী আর বলব!’’ সগর্বে বলে চলেন প্রৌঢ়। আরশাদের কথায়, ‘‘মোটরবাইকের আসল টায়ারের দাম সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আমি হাজার থেকে বারেশো টাকায় দিচ্ছি। ভাবুন আপনার খরচ হতো ষোলো হাজার। সেখানে আমি দিচ্ছি চার হাজারে। বছরে আপনার ১২ হাজার টাকা পকেটে থেকে গেল। আপনার তো ছ’টা গাড়ি। বছরে ৭২ হাজার। ভাবুন!’’ ঘণ্টাখানেক থাকতে হবে। অগত্যা আরশাদের তক্তপোষে এ বার পা গুটিয়ে বসি আমিও। ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে ফের কথা শুরু করেন প্রৌঢ়।

এক সময়ে মল্লিকবাজারের গাড়ির যন্ত্রপাতির বাজারে দোকানে কাজ করতেন আরশাদ। সেখানেও রিসোল টায়ার বিক্রি হতো। কিন্তু নিঁখুত হতো না। তার পরে এক দিন নিজেই বাইপাসের ঝুপড়ি ভাড়া নিলেন আরশাদ। দিনের পর দিন মল্লিকবাজারের দোকানের কাজের শেষে শুরু হল নকশা খোদাই (গ্রাফটিং) অভ্যাস করা। বছরখানেকের অভ্যাসে এখন একেবারে নিঁখুত কাজ। মল্লিকবাজারের দোকানের কাজও ছেড়ে দিয়েছেন বেশ অনেক দিন হল।

কথার ফাঁকেই ঝুপড়িতে একের পর এক খদ্দের আসছেন। দরদাম চলছে। মোটরসাইকেল, ট্যাক্সি ছাড়াও বড় বড় দামি গাড়িও আসছে। আরশাদের শাগরেদ, বছর বারোর আমিন(নাম পরিবর্তিত) চাকা বদলে দিচ্ছে। ‘ফিটিং-চার্জ’ চারশো টাকা নগদে গুনে নিচ্ছেন প্রৌঢ়।

খরিদ্দার সামলে মাঝেমধ্যেই আরশাদ এসে বসছেন তক্তপোষে। সিগারেট ধরাচ্ছেন। আর বোঝাচ্ছেন, তাঁর তৈরি রিসোল টায়ার কতটা ঝুঁকিহীন ও লাভজনক। প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘একটি বাসের চাকার দাম প্রায় ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আমি ১০ হাজারে দিয়ে দিচ্ছি। বাসের ছ’টা চাকায় ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা লাভ থেকে যাচ্ছে।’’ তার তৈরি রিসোল টায়ারের ‘গ্যারান্টি’ এক বছরের। খারাপ হলে সরাসরি টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

কিন্তু ঝুঁকি? এ বার একটু কিন্তু কিন্তু করতে থাকেন এতক্ষণের আত্মবিশ্বাসী প্রৌঢ়। তাঁর কথায়, ‘‘আচমকা ব্রেক কষলে কিন্তু ঝুঁকি আছে।’’ একটু নিচু গলায় এ বার প্রৌঢ় বলতে থাকেন, ‘‘দেখুন, আসল আর নকলের কার্যকারিতায় একটু ফারাক তো থাকবেই। নকশা যতই নিঁখুত করুন না কেন, বাটালি আর মেশিনের কাজের তফাত তো থাকেই! মেশিনে তৈরি আসল টায়ার যতটা মাটি কামড়াতে পারে, আমাদের তৈরি নকল টায়ার ততটা সক্ষম নয়। শুধু বর্ষার সময়টা একটু সামলে চলবেন, তা হলেই হল! আমি কিন্তু সব খরিদ্দারকে এটা বলে দিই। আপনাকেও বলে দিলাম। আরে বাবা, বর্ষা আর ক’দিন!’’

কথায় কথায় কখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে বুঝতেই পারিনি। মোবাইলে রিসোল টায়ারের উপরে আরসাদের হাতের কাজের গুটিকয়েক ছবি তুলে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে আরশাদ একটা ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে দেন হাতে। বলেন, ‘‘আমার মোবাইল নম্বর রয়েছে। বাবাকে ছবি দেখিয়ে যদি পছন্দ হয়, আমাকে একটা ফোন করে ড্রাইভারের হাতে টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আপনাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না।’’

লালবাজারের ট্রাফিক দফতরের এক পুলিশকর্তার কথায়,‘‘এটা একটা নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তবে যাঁরা রিসোল টায়ার ব্যবহার করবেন, তাঁরা তো সমস্যায় পড়বেনই। দূর্ঘটনা ঘটলে ওঁদের ঝুঁকিই বেশি। মানুষ সচেতন না হলে কিছুই করার নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন