ডেঙ্গির প্রকোপে ফি বছর কাবু হচ্ছে কলকাতা। পিছু ছাড়ছে না ম্যালেরিয়াও। প্রতি বছরই ম্যালেরিয়ায় বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে রাজ্যে। অভিযোগ, তার পরেও কলকাতা পুরসভা বা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এ বিষয়ে উদাসীন। অথচ ম্যালেরিয়া যে রাজ্যকে অনেকটাই কাবু করে রাখছে বছরের পর বছর, সেই ওড়িশা এখন নড়েচড়ে বসেছে। চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশের প্রশ্ন, ও়ড়িশা যদি পারে, তা হলে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ পারবে না কেন?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, ম্যালেরিয়ার আক্রমণে ওড়িশা দেশের মধ্যে প্রথম। আর পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয়। ২০১৬ সালে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুতে ওড়িশা ছিল শীর্ষে। মৃতের সংখ্যা ৭৭। দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। মৃত ৫৯।
ওড়িশা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, যোগাযোগে সমস্যা এবং পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী অধ্যুষিত দক্ষিণ ওড়িশায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত সর্বাধিক। যুগ্ম অধিকর্তা মদনমোহন প্রধান বলেন, ‘‘ম্যালেরিয়া যুদ্ধে রাজ্য সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ২০১৬-র মার্চে টাটা ট্রাস্টের সঙ্গে মৌ সই করেছে। সরকারি সাহায্য দুর্গম এলাকাগুলিতে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য। কন্ধমাল, কালাহাণ্ডি ও রায়গড়ের পাঁচটি ব্লকের ৬২৩টি গ্রামে কাজ করবে সংস্থা।’’ টাটা ট্রাস্টের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার (স্বাস্থ্য) জয়িতা চৌধুরী বলেন, ‘‘পাঁচ বছরে মৃত্যু অন্তত ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে। দ্রুত এই রোগ নির্ধারণে রক্ত পরীক্ষা জরুরি। প্রত্যন্ত গ্রামেও সেই পরিষেবা রাখা হচ্ছে। রক্তে ম্যালেরিয়া ধরা পড়লে আমাদের চিকিৎসক তৎক্ষণাৎ রোগীকে ওষুধের ব্যবস্থা করেন।’’
দ্বিতীয় স্থানে থাকা পশ্চিমবঙ্গের লড়াই এখনও শুধু সরকারি স্তরেই সীমাবদ্ধ। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, এ বছর এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ম্যালেরিয়ায় মৃত ১৪। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অংশ, মুর্শিদাবাদ ও জলপাইগুড়ি ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা। দফতর সূত্রের খবর, মৃত্যুর কারণগুলির একটি, হাতুড়ের কাছে যাওয়ায় চিকিৎসায় দেরি। অন্যটি, নয়া মেডিক্যাল অফিসারদের ম্যালেরিয়া চিকিৎসার প্রোটোকল না জানা। এন্টেমোলজিস্ট অমিয় হাটির কথায়, ‘‘৯৯-এ ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া ছিল এ শহরে ৫৫ শতাংশ। এখন এগিয়ে ভাইভ্যাক্স। ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ারও কিছু দৃষ্টান্ত পাচ্ছি। তাই সজাগ থাকতে হবে কলকাতাকে।’’
কলকাতা পুরসভার মেয়র অতীন ঘোষ বলেন, ‘‘শহরে ম্যালেরিয়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ৯ ও ৫ নম্বর বরোতে বেশি সমস্যা। ভিন্ রাজ্যের মানুষ ওখানে বেশি থাকেন, যাঁরা ওষুধ পুরো খান না। কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি এঁদের নজরে রাখতে। গত বছরের তুলনায় এ বার এক চতুর্থাংশ কমেছে ম্যালেরিয়া রোগী। তার কারণ জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতার প্রচার শুরু হয়েছে।’’
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীরও দাবি, তাঁরা মোটেই উদাসীন নন। ‘‘গত এক বছরে নতুন ডাক্তার এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ইন্ডোরে র্যাপিড ডায়াগনস্টিক কিট রাখা হচ্ছে, যাতে ২৪ ঘণ্টা মানুষ ওই পরিষেবা পেতে পারেন। ‘ফিভার ক্যাম্প’ হচ্ছে। মুর্শিদাবাদের দুর্গম জায়গা, রানিবাঁধ, বাঘমুণ্ডিতে এ বছর থেকে মোবাইল মেডিক্যাল ক্যাম্পও শুরু হয়েছে’’-বলেছেন বিশ্বরঞ্জনবাবু।
ওড়িশার থেকে কী শিখতে পারে এ রাজ্য? উদাহরণ মিলেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকেই। কন্ধমাল জেলার একটি গ্রাম বুড়াবিরমহা। পাহাড়, জঙ্গল আর নদী দিয়ে ঘেরা ঘন সবুজ ছোট্ট গ্রাম। ষাট-সত্তর ঘর কন্ধ উপজাতির একমাত্র ভাষা কুঁই। ঝুম চাষ আর মজুরি খেটে রোজগার। ভুবনেশ্বর থেকে গ্রামে আসতে গাড়িতেই লাগে এগারো ঘণ্টা। সরকারি স্বাস্থ্য কর্মীর (আশা) দেখা মেলে না এখানে। প্রতি ঘরে থাবা গেড়েছে ম্যালেরিয়া। ভরসা বলতে, বহু দূরের হাতুড়ে ডাক্তার। গ্রামের নিয়ন্তি মল্লিকের মনে আছে, এক বছর আগে প্রবল জ্বরে ভুগছিল বছর তিনেকের মেয়ে। হাতুড়ের কাছে নিয়ে গেলে ওষুধ, স্যালাইন ও এক রাত থাকা— মিলিয়ে খরচ হয় দেড় হাজার টাকা। এক বছরেই সেখানকার ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। বিভিন্ন গ্রামে মশারি বিলি হয়। তা টাঙিয়ে শোওয়ার জন্য চার্চ থেকে প্রতি রাতে ঘণ্টা বাজিয়ে সচেতন করা হয় বাসিন্দাদেরও।
এ রাজ্য কবে তা শিখবে?
সেই প্রশ্নের উত্তর স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে মেলেনি।