বিপদের নাম প্লাস্টিক

জরিমানার বালাই নেই, নিরুত্তাপ শহরবাসীও

হিসেবটা এক সময়ে কষে দেখেছিল রাজ্য পরিবেশ দফতর। যে রাস্তা তৈরিতে খরচ হয়েছে ১ লক্ষ টাকা, তার হাল খারাপ করার জন্য মাত্র ১০ টাকার প্লাস্টিকই যথেষ্ট! ব্যাপারটা কী রকম?

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০৩:২১
Share:

হিসেবটা এক সময়ে কষে দেখেছিল রাজ্য পরিবেশ দফতর। যে রাস্তা তৈরিতে খরচ হয়েছে ১ লক্ষ টাকা, তার হাল খারাপ করার জন্য মাত্র ১০ টাকার প্লাস্টিকই যথেষ্ট!

Advertisement

ব্যাপারটা কী রকম? পরিবেশ দফতরের বক্তব্য ছিল, ১০ টাকা মূল্যের ফিনফিনে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগ নর্দমার মুখ আটকে দিলে যতটা রাস্তায় জল জমে থাকবে বা আখেরে খারাপ করে দেবে, তা তৈরিতে খরচ হয় ১ লক্ষ টাকা।

এ বার বর্ষায় কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ তল্লাটে দীর্ঘ সময় জল জমে থাকছে। এর অন্যতম কারণ যে প্লাস্টিক, তা মানছে পুরসভা, প্রশাসন ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘পুরসভাগুলি ক্রেতা-বিক্রেতাদের থেকে জরিমানা আদায় করছে না। প্লাস্টিকের প্যাকেটের কারখানাকে ট্রেড লাইসেন্স দেয় পুরসভা। ওদের আগে কঠোর হওয়া দরকার।’’

Advertisement

পরিবেশ দফতরের এক কর্তা জানান, বছরের গোড়ায় তিনি দক্ষিণ দমদম পুরসভার এক কাউন্সিলরের কাছে স্থানীয় বাজারে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের রমরমা নিয়ে অভিযোগ করেন। কাউন্সিলর জানান, পুরভোটের পরে দেখবেন। পুনর্নির্বাচিত হয়ে ওই কাউন্সিলর ব্যবসায়ীদের বলেন, নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করলে তাঁদের বসতে দেওয়া হবে না। তাতেই কাজ হল। কল্যাণবাবুর মতে, ‘‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া প্লাস্টিকের দূষণ রোখা মুশকিল।’’

গড়িয়া, পাটুলি, বৈষ্ণবঘাটার কিছু তল্লাটে এ বার বৃষ্টির জল জমে ভোগান্তি চরমে। স্থানীয় কাউন্সিলর ম্যানহোল পরিষ্কার করাতে গিয়ে দেখেন, উঠে আসছে শুধু প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ। অর্থাৎ, ভোগান্তির কারণ বাসিন্দারাই।

অথচ পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে ৪০ মাইক্রনের কম মোটা এবং ১৬ বাই ১২ ইঞ্চির চেয়ে ছোট প্লাস্টিক প্যাকেট নিষিদ্ধ। আবার, নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে দোকানদারের থেকে ৫০০ টাকা ও ক্রেতার থেকে ৫০ টাকা জরিমানা আদায়ও এখন কার্যত বন্ধ।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে ২০১১-র ৩০ জুন এক বিজ্ঞপ্তিতে পরিবেশ দফতর গুটখা, তামাক ও পানমশলার প্যাকেটে প্লাস্টিকের মোড়ক নিষিদ্ধ করেছিল। সম্প্রতি আবার ওই সব প্যাকেটে দাপটে ফিরে এসেছে প্লাস্টিক।

কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক ‘প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুল্‌স, ২০১৫’ নামে নয়া যে বিধি আনছে, তাতে ৫০ মাইক্রনের কম মোটা হলেই প্লাস্টিক ব্যাগকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু নতুন বিধিও কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পরিবেশপ্রেমীরা।

পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘নজরদারি ও কঠোর মনোভাবের অভাবে প্লাস্টিকের দাপট বেড়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, বছর দশ আগে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের সুবিধার্থে প্লাস্টিকের প্যাকেটে টাকা দেবে বলে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু পর্ষদ তাদের জানায়, তা হলে ব্যাঙ্ক বন্ধ করে দেওয়া হবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কও দাঁড়ায় পর্ষদের পাশে।

নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যবহারের জন্য একটি দেশব্যাপী জুতোর চেনের বিপণি চুঁচুড়ায় বন্ধ করেছিল পর্ষদ। বন্ধ হয়েছিল চন্দননগরের এক মিষ্টির দোকানও। ৭-৮ বছর আগে প্লাস্টিকের ব্যাপারে নিয়ম ভাঙা বিভিন্ন সংস্থার থেকে দশ হাজার, পাঁচ হাজার টাকা ‘দূষণ মূল্য’ আদায় করা হয়েছিল। আবার, সচেতনতা প্রসার অভিযানের অঙ্গ হিসাবে নিয়ম ভঙ্গকারী সংস্থাগুলিকে দিয়েই ২০১১-র ৪ জানুয়ারি ময়দান পরিষ্কার করায় পর্ষদ।

পর্ষদের এক কর্তা বলেন, ‘‘প্লাস্টিক প্রত্যেকেই কমবেশি ব্যবহার করেন। মানুষ সচেতন না হলে কিছুই হবে না।’’ পুরসভা ও পর্ষদের বক্তব্য, থলি না নিয়ে বাজারে যাওয়া, থলি থাকলেও প্লাস্টিক ব্যাগে জিনিস দিতে জোর করা, ডিপ ফ্রিজে মাছ থেকে ট্রলিব্যাগে চপ্পল— সব প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখার প্রবণতা গ্রাস করেছে অনেককে। টালিগঞ্জে এক মিষ্টির দোকানের মালিক বলেন, ‘‘দেওয়ালে পুর-নোটিস আটকে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগ দেওয়া বন্ধ করি। কিন্তু খদ্দেরদের প্রবল অনুরোধে ফেরাতে বাধ্য হলাম।’’

ওই পর্ষদ কর্তা তাই বলছেন, ‘‘প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের অনর্থক ব্যবহার অভ্যাসে পরিণত। তাই, প্রথম ধাক্কাটা জরিমানার মাধ্যমেই হওয়া দরকার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন