স্বঘোষিত দাদাদের দৌরাত্ম্যে ত্রস্ত শহরবাসী, প্রতিকার কি মিলবে?
Coronavirus Lockdown

সিন্ডিকেট লাটে, দাদাদের দখলে এখন ফুড কুপনের ঝাঁপি

রেশনের চাল হোক কিংবা আমপানের ত্রাণ, রাজারহাট বা দমদম এলাকায় সবই বিলি হয়েছে প্রচুর। আর সে সব নিয়ে দাদাগিরির অভিযোগও বিস্তর।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০ ০৩:১৬
Share:

ডিজিটাল রেশন কার্ড বা ফুড কুপন পাননি। লকডাউনে কাজ হারিয়ে ঠিক মতো খাবার জুটছে না এই মহিলার মতো অনেকেরই। নিজস্ব চিত্র

বাগুইআটির মোড়ে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে এক অটোচালক বললেন, ‘‘জেজেটিটি। যখন যেমন, তখন তেমন।’’ রাজারহাট-গোপালপুর কিংবা দমদমে দাদাগিরির কায়দা এমনই। এক সময়ে পানশালা থেকে টাকা তোলার রমরমা ব্যবসা ছিল এই অঞ্চলের দাদাদের। এখানকার সিন্ডিকেট রাজত্বের গল্প জায়গা পেয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতেও। করোনার পরিবেশে পানশালা, নির্মাণস্থল, সবই বন্ধ। অভিযোগ, তাই দাদাদের অনেকেই এখন হাত পাকিয়েছেন আমপানের ত্রাণ আর করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের খাবারের কুপন বিলির মধ্যে দিয়ে এলাকায় নিজেদের দাপট কায়েম রাখতে।

Advertisement

রেশনের চাল হোক কিংবা আমপানের ত্রাণ, রাজারহাট বা দমদম এলাকায় সবই বিলি হয়েছে প্রচুর। আর সে সব নিয়ে দাদাগিরির অভিযোগও বিস্তর। ত্রাণ কিংবা রেশনের চাল কে পাবেন, আর ফুড কুপনের জন্য কাকে পার্টি অফিসে দেখা করতে হবে, দাদাদের মর্জির উপরেই তা নির্ভর করছে বলে অভিযোগ। রাজারহাটের আটঘরা, জোলপাড়া, কালীপার্ক, গোপালপুর হাউজ়িং-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে এমনই অভিযোগ উঠে এসেছে।

আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘জনদরদি’ ভাবমূর্তি তৈরি করতেই এখন মরিয়া এলাকার বড়, মেজো, সেজো স্তরের দাদা-দিদিরা। কানাঘুষো এমনই যে বিরোধী দল তো বটেই, শাসক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ত্রাণ বণ্টন নিয়ে রেষারেষি বেধে গিয়েছে। এক বিরোধী নেতার অভিযোগ, ‘‘এক বারের বেশি দু’বার ত্রাণ দিতে গেলে আমাদের অঞ্জন দত্তের গান ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব’ বলে শাসানি দেওয়া হচ্ছে। তাই আর ত্রাণ দিতে যেতে সাহস করেননি অনেকেই।’’

Advertisement

অভিযোগ, রেশনের ফুড কুপন ইচ্ছেমতো বিলোচ্ছেন দাদা-দিদিরাই। যেমন, দাদার দাক্ষিণ্য মেলেনি বলে রাজারহাটের আটঘরার বিশ্বাসপাড়ার এক মহিলার বাড়ির সদস্যেরা সবাই এখনও রেশন কার্ডই পাননি। তিনি জানান, তাঁরা মাত্র তিনটি ডিজিটাল রেশন কার্ড পেয়েছেন। ওই মহিলা বলেন, “পাড়ার দাদারা বলেছিল রেশন কার্ড না থাকলেও ফুড কুপন করে দেবে। কিছুই দেয়নি। করোনায় কাজ হারিয়েছি। ঘরে আনাজ নেই, মাংসের ছাঁট দিয়ে ভাত খাচ্ছি।” রাজারহাট-গোপালপুরের বাসিন্দা আর এক মহিলার অভিযোগ, ‘‘শাসক দলে নাম লিখিয়ে, আর দাদাদের জন্য কাজ করে সহজেই ফুড কুপন পেয়েছেন অনেকে। ফুড কুপন কোথাও কোথাও পার্টি অফিস থেকেও দেওয়া হচ্ছে। দাদাদের নির্দেশ, পার্টি অফিসে এলে সব পেয়ে যাবে।” অভিযোগ, ওই পার্টি অফিস থেকে বিলি হওয়া চাল আবার খোলা বাজারে বিক্রিও হচ্ছে।

কী ভাবে ফুড কুপন নিয়ে দাদাগিরি হচ্ছে? ডিজিটাল রেশন কার্ড নেই যাঁদের, আবেদন করলে তাঁরাই ফুড কুপন পাবেন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ, আবেদনকারীর ফুড কুপন এলেও সেগুলি দাদারা নিজেদের লোকজনের মধ্যে বিলি করছেন। সেই কুপন নিয়ে রেশন দোকানে গিয়ে সেই দাদার নাম বললে পরিচয়পত্র ছাড়াই মিলে যাচ্ছে মাথা পিছু পাঁচ কেজি চাল এবং এক কেজি ছোলা।

উত্তর ২৪ পরগনার কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি সোমেশ্বর বাগুই বলেন, “ফুড কুপন না পেলেও দাদাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। তাই আমাদের দাবি ফুড কুপন কাদের দেওয়া হচ্ছে তার তালিকা বরো অফিসে বা ওয়ার্ড অফিসে ঝোলানো হোক। এর বিরুদ্ধে আমরা বিধাননগর পুরসভায় স্মারকলিপিও দেব।” যদিও বিধাননগরের ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পুরো প্রক্রিয়াই স্বচ্ছ ভাবে হচ্ছে। দাদাগিরির কোনও অভিযোগ আসেনি।”

আবার ত্রাণ দেওয়ার অধিকার নিয়ে দক্ষিণ দমদমের মধুগড় ও দক্ষিণ সুভাষনগরে কয়েক বার গোলমালের খবর পাওয়া গিয়েছে। এলাকার খবর, পুলিশে অভিযোগ হলেও ওই ঘটনার পরে ওই সব এলাকায় বিরোধী দলের লোকজন ত্রাণ দিতে যেতে সাহস করেননি। ফলে অনেক জায়গাতেই গরিব মানুষ ত্রাণ পাননি।

দক্ষিণ সুভাষনগরের খালপাড় এলাকার কয়েক জন বাসিন্দার কথায়, “আগে কয়েক বার ত্রাণ এসেছে। এখন আর আসে না। দাদাদের পিছনে না ঘুরে আমরাই এলাকার গরিব মানুষদের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি।” যদিও দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যানের সাফ কথা, “প্রতিটি ওয়ার্ডে সরকারি হিসেব মেনেই ত্রাণ গিয়েছে। কোনও দাদাগিরি হয়নি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন