একান্তে: শুক্রবার, প্রিন্সেপ ঘাটে। ছবি: সুমন বল্লভ
কলেজে পড়া ছাত্রী। সকলের মতো চোখে একরাশ স্বপ্ন। তার মধ্যেই ছন্দপতন। অনেক দিন ধরে একটি ছেলে বিরক্ত করছিল মেয়েটিকে। সমানে তাঁকে নিজের ভাললাগার কথা জানাচ্ছিল। কিছুটা জোর করেই। প্রথমে গুরুত্ব দেননি শবনম। ‘না’-ই বলেছিলেন। তখনও জানতেন না এর পরিণাম কী হতে পারে!
এক দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে বেজে উঠল বেল। শবনম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলেছিলেন, সেই ফাঁকে তাঁর ‘না’ বলার জবাবে অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ছেলেটি। প্রেমে ‘না’ বলার শাস্তি হিসেবে নেমে এসেছিল অ্যাসিড-শাসন!
এমবিএ শেষ করে এই মুহূর্তে বেঙ্গালুরুতে চাকরি করছেন শবনম। তরুণী বলছেন, ‘‘সম্পর্কের প্রস্তাবে না করেছিলাম। তার জন্য এক জন অ্যাসিড ছুড়েছিল। তাই বলে সকলের উপর থেকে, প্রেমের উপর থেকে আস্থা হারাব কেন!’’
রবিবার সরস্বতী পুজো। তবে পঞ্জিকা মতে, আজ, শনিবার সকাল দশটা থেকেই পঞ্চমী তিথি পড়ে যাচ্ছে। তাই অনেকেই শনি ও রবি দু’দিনই সরস্বতী পুজো পালন করছেন। ভ্যালেন্টাইন্স ডে বৃহস্পতিবার। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, ‘আকাশের গায়ে না কি প্রেম-প্রেম গন্ধ’! কিন্তু সেই রসিকতা, আসন্ন প্রেম-উৎসবের মধ্যেও কিছুতেই কয়েকটি অস্বস্তির পরিসংখ্যান পিছু ছাড়ছে না। তথ্য বলছে, আগে অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যায় সেরা দেশে সব থেকে উপরে ছিল উত্তরপ্রদেশ। বর্তমানে সেই অগৌরবের পালক বাংলার মুকুটে! মেয়েদের উপরে হিংসা ক্রমাগত বাড়ছে।
আরও পড়ুন: সঙ্গে থাক নৈঃশব্দ, সংসার পাতছেন যুগল
যাকে ভালবাসা যায়, তার বুকে কী ভাবে ছুরিকাঘাত করা যায়? — বহু আগে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রয়াত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বিস্মিত হয়েছিলেন প্রেম-প্রত্যাখান ও তার পরিণতি দেখে। কবি জয় গোস্বামীও বলছেন, প্রেমে প্রত্যাখান তো বিষণ্ণ করে মানুষকে। সেখানে আক্রোশ কী ভাবে বেরোয়! জয় বলছেন, ‘‘প্রেমের প্রত্যাখানের কারণে যদি হিংসার উদ্রেক হয়, বুঝতে হবে কোথাও বিকৃতি আছে।’’
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে অ্যাসিড আক্রমণের যতগুলি ঘটনা ঘটেছে, তার ২৬ শতাংশ ঘটনা এ রাজ্যের। ২০১৫-’১৬ সালে ৮১টি এরকম ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে দিব্যলোক রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘অ্যাসিড আক্রান্তের অনেকেই লড়াই করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। তাঁরা ভরসা হারাননি জীবনের উপর থেকে, ভালবাসার উপর থেকে।’’
জয়ের কথায়, ‘‘ভরসা যাবে কী করে! প্রেমে তো মাধুর্য আছে। তরুণ-তরুণীরা তো বটেই, অসময়ের প্রেমেও তাই ভীষণ ভাবে পড়েন মানুষ!’’ আর তাই গোলাপ-পলাশে মাখামাখি সব। মল্লিকঘাট ফুল ব্যবসায়ী
পরিচালন সমিতির কোষাধ্যক্ষ গৌতম সমাদ্দার বলেন, ‘‘গোলাপের চাহিদা শুরু হয়ে গিয়েছে। ডাচ গোলাপ আর স্থানীয় গোলাপের চাহিদাই সব থেকে বেশি। সরস্বতী পুজোর জন্য পলাশও রয়েছে। আসলে আবহাওয়াটা তো ভাল।’’
ফুরফুরে আবহাওয়ার কারণে প্রেম নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে, বলছেন লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর মতে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রেমের বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, তাই এত শোরগোল ওই দিন ঘিরে। বাঙালির কাছে প্রেমের দিন হিসেবে সরস্বতী পুজোর আকর্ষণ আদি ও অকৃত্রিম! তাঁর মতে, সরস্বতী পুজোয় একটা লাইসেন্স পাওয়া যায়। মফস্সল, গ্রামের দিকেও এ দিন নিশ্চিন্ত হয়ে হাতে-হাত ধরে ঘোরাই যায়। সে খবর বাড়িতে পৌঁছবে না যেন। শহরে এই দিনটা বাকিদের পাত্তা না দিলেও চলে। প্রেমিক-প্রেমিকাকে কোথাও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে দেখলেই তো হুমড়ি খেয়ে দেখতে থাকে এ শহর। পাহারাদারের নজর থেকে যেন এ দিনটায় একটু মুক্তি মেলে। স্মরণজিতের কথায়, ‘‘এ দিনটায় ওই চাউনি বা কৌতূহলকে অগ্রাহ্য করা যায়! স্পর্ধাও দেখানো যায়!’’
যেমনটা স্পর্ধা দেখিয়েছিল রক্তকরবীর সেই কিশোর। নন্দিনীকে বলেছিল— ‘ওদের মারের মুখের উপর দিয়েই রোজ তোমাকে ফুল এনে দেব।’
অন্তত পক্ষে দশটা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় রক্তকরবীর, যা ক্রমাগত পরিমার্জনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জানাচ্ছেন শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য। নাটকের নাম পরিবর্তন, মূল চরিত্রের নাম পরিবর্তন, বই হিসেবে প্রকাশে তাড়াহুড়ো না করা-সহ একাধিক ইতিহাস-স্মৃতি ছুঁয়ে আছে এ নাটক। সৌরীনবাবুর কথায়, ‘‘নাটকের প্রথম পাঠে রক্তকরবী ফুলের কথা কিন্তু এক বারও আসেনি। দ্বিতীয় পাঠে এসেছিল মাত্র দু’বার। যে ভাবে ক্রমাগত রবীন্দ্রনাথ এ নাটক পরিমার্জনা করেছিলেন, এত দিন ধরে যুক্ত ছিলেন সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে, সেটাই পৃথক চর্চার বিষয়। শেষ পর্যন্ত সজীব প্রাণকে ধ্বংস করা যাবে না,—রক্তকরবীর বার্তা কিন্তু এটাই। আর নন্দিনী হল সেই সজীব প্রাণের প্রতীক।’’
আর শবনম বলছেন, ‘‘সঠিক মানুষটা আপনার সঙ্গে থাকলে, পাশে থাকলে আলাদা করে প্রেমের দিন লাগে না বোধহয়! ফলে ভালবাসার উপর থেকে ভরসা হারানোর কোনও প্রশ্নই নেই!’’
সত্যিই ভরসা হারাবে কেন! আর জয়, যিনি কিশোর আর নন্দিনীর সেই কথোপকথনকে ভেঙে দিয়েছিলেন কবিতায়, আর কবে, সেই কবেই লিখে দিয়েছিলেন স্মৃতিযোগ্য সে-সব পংক্তি— ‘সামলে চলার প্রশ্নই নেই/ প্রেমের কাছে শাসন তুচ্ছ/ এনে দিচ্ছি প্রহরীদের/ মারের মুখের ওপর দিয়ে/ তোমাকে এই ফুলের গুচ্ছ!’
শাসন-উপেক্ষা করা সেই স্পর্ধাকেই আবার দেখতে পাবে শহর!