ভোট-প্রক্রিয়া পর্বে ছ’শোরও বেশি বেআইনি নির্মাণ হয়েছে শহর জুড়ে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরসভার ভূমিকা ছিল কার্যত ‘নির্বাক দর্শক’। পুরসভা সূত্রে খবর, কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর এলাকায় গত দু’মাসের মধ্যে ওই বেআইনি নির্মাণ হয়েছে। কার্যত নির্বাচন কমিশনের চাপেই এবং ভোট-প্রক্রিয়া চলাকালীন কলকাতা পুলিশ অনেকটাই আক্রমণাত্বক থাকায় সেই সংখ্যায় আপাতত লাগাম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে ভোট শেষ হতেই ফের তা মাথাচাড়া দেবে কি না এ নিয়ে সংশয় থেকেই গিয়েছে।
একাধিক পুর-অফিসারের কথায়, নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন ঘোষণা করতেই নির্বাচনী আচরণ বিধি লাগু হয়ে যায়। এ বার ভোট-প্রক্রিয়া চালু হয় মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে। সাধারণত, তার পর থেকে প্রায় সব দফতরের কাজেই ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায়। বিল্ডিং দফতরের দায়িত্ব ছিল খোদ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের হাতেই। সময় যত এগিয়েছে নেতা মন্ত্রীদের পাশাপাশি ভোটের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। অর্থাৎ নজরদারি তেমন ছিলই না বললেই চলে। সেই সুযোগকে ব্যবহার করেছেন বেআইনি নির্মেণের সঙ্গে যুক্ত মূলত এক শ্রেণির প্রোমোটারেরা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে পুর-অফিসারেরা কেন কোনও পদক্ষেপ করেননি?
বিল্ডিং দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘প্রথমত, বন্দর এলাকায় বেআইনি নির্মাণে বাধা দিতে গিয়ে বহু বার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন পুরকর্মীরা। দ্বিতীয়ত, এমনও দেখা গিয়েছে কোনও কোনও বেআইনি নির্মাণের পিছনে শাসক দলের নেতা-কর্মীর মদত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাধা দিতে গেলে উল্টো ফল হবে বুঝেই পুরসভা আর এগোতে চায় না। ওই অফিসার আরও জানান, টালিগঞ্জে বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে গিয়ে খোদ বরো চেয়ারম্যানের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল পুর-অফিসারদের। গার্ডেনরিচ থেকে তিলজলা একাধিক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হুমকিতে পিছিয়ে আসতে হয়েছে পুরকর্মীদের। পুলিশের সামনেই হেনস্থা হতে হয়েছে পুর-অফিসারদেরও। তাই ‘জীবন বিপন্ন’ করে কেউ আর গার্ডেনরিচ, তিলজলা-সহ একাধিক এলাকায় সাহস করে বেআইনি নির্মাণে বাধা দিতে যায় না। পাল্টা অভিযোগও রয়েছে একাধিক কাউন্সিলরের। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ-পুরসভাকে ‘নজরানা: দিয়েই বেআইনি কাজ কারবার হয়ে থাকে।
যদিও এ বার ভোটের সময় ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখেছেন পুরকর্মীরাই। তা কেমন?
বিল্ডিং দফতরের এক এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জানান, ভোটের মধ্যেই একবালপুরের ব্রাউনফিল্ড রোডে একটি বাড়িতে পুর-অনুমোদন ছাড়াই দু’টি তল বাড়ানো হচ্ছিল। পুরসভা তা দেখেও দেখেনি। কিন্তু নজর এড়ায়নি পুলিশের। ভোট-প্রক্রিয়া চলাকালীন কলকাতা পুলিশ অনেকটাই আক্রমণাত্বক ছিল। ডিসি-র উপস্থিতিতে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বেআইনি নির্মাণ হলেই তা আটকানো হবে। ১৬ মে দুপুরে পুলিশ অভিযান চালায়। বিল্ডিং দফতরের ওই ইঞ্জিনিয়ার জানান, পুলিশ ওই বাড়িতে উঠছে, এই খবর পেয়েই পালাতে গিয়ে পড়ে যায় দু’জন। নির্মিয়মাণ বাড়ির চাঙড় ভেঙে আহত হন আরও কয়েক জন।
ওই পুর-অফিসার জানান, পুলিশকে সঙ্গে পেয়ে গত দু’মাসে সাড়ে তিনশোরও বেশি এফএইআর করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ সুয়োমোটো ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু ভোটের ফল বেরোতেই সেই উদ্যোগে ফের ভাটা পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ওই অফিসারের। তাঁদের ধারণা, শাসক দলের কিছু নেতা-কর্মীর যোগসাজশে এই বেআইনি নির্মাণ বেড়েই চলেছে গত ৫ বছরে। পুরসভা কিছু ক্ষেত্রে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তা নেহাতই কম। বিষয়টি নিয়ে অবগত মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সব কিছু খতিয়ে দেখব।’’
যদিও পুলিশেরই একাংশ জানিয়েছে, কলকাতা পুরসভার ৭৭, ৭৮ এবং ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ২০০টির মতো বেআইনি নির্মাণ চলছে। এর মধ্যে একবালপুরের এম এম আলি রোড, একবালপুর লেন, ডাক্তার সুধীর বসু রোড, ইব্রাহিম রোড, দক্ষিণ বন্দর এলাকার কার্ল মার্কস সরণি-সহ একাধিক এলাকা রয়েছে। কোথাও দোতলা পর্যন্ত নির্মাণের অনুমতি থাকলেও সেখানে চার তলার উপরে ঢালাই হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই এক মাসের মধ্যেই চার-পাঁচটি তল নির্মাণ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তাই কী ব্যবস্থা নেয় পুর-প্রশাসন তা দেখার অপেক্ষায় এলাকাবাসীও।