হাসপাতালে সইদা গুলালই। পাশে তার বাবা জাহিদ হুসেন। ছবি: প্রতিবেদক।
এমনিতে হাসপাতালের মামুলি কেবিন। কিন্তু ঢাকুরিয়ার ওই বেসরকারি হাসপালের ১৪০৮ নম্বর ঘরটা আপাতত ভারত-পাক মৈত্রীর ভাল বিজ্ঞাপন!
দু’দেশের মধ্যে বিরোধ, উত্তেজনা ও সংঘাত রুটিনে পরিণত হলেও পাকিস্তানের ষোলো বছরের এক মুমূর্ষু কিশোরীর উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতে পাঠিয়েছে শান্তির নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই। মালালার চেয়ে এক বছরের ছোট, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, পেশোয়ারের ওই কিশোরীর নাম সইদা গুলালই। তাকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে মালালা ভরসা করেছে কলকাতার চিকিৎসকদের উপরে। গত বুধবার বাবার সঙ্গে শহরে পৌঁছনো ইস্তক গুলালাইয়ের ঠিকানা ঢাকুরিয়ার হাসপাতাল। দু’দিন আইসিইউ-তে রাখার পর শুক্রবার তাকে রাখা হয়েছে পাঁচ তলার ওই কেবিনে।
কী হয়েছে গুলালইয়ের?
জন্ম থেকেই জোরে হাঁটলেই তার হাঁপ ধরে যায়, দৌড়ঝাপ করতে পারে না। রক্তে ৭৫ শতাংশের বেশি অক্সিজেন মেশে না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এর নাম ‘পালমোনারি আটরেসিয়া উইথ ভিএসডি’। ব্যাপারটা ঠিক কী? হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সত্যজিৎ বসু বললেন, “এ ক্ষেত্রে রোগীর হৃৎপিণ্ডে জন্ম থেকেই একটি বড় ফুটো থাকে। সেই সঙ্গে ডান দিকের নিলয় থেকে ফুসফুসে রক্ত যাওয়ার রাস্তা তৈরি হয় না। কিন্তু মহাধমনী থেকে ফুসফুসে রক্ত যাওয়ার জন্য আপনা-আপনি কয়েকটি ধমনী তৈরি হয়ে গিয়েছে। আর সম্ভবত সেই জন্যই মেয়েটি ষোলো বছর পর্যন্ত বেঁচে আছে।” এ ক্ষেত্রে সমস্যা কী? সত্যজিৎবাবুর কথায়, “বাঁ দিকের নিলয় থেকে পরিস্রুত রক্তের বদলে দূষিত রক্ত শরীরে ছড়াচ্ছে।”
শুক্রবার দুপুরে হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে স্মিত হাসি মুখে নিয়ে গুলালই বলছিল, “পেশোয়ারে তালিবানি ফতোয়ার বিরুদ্ধে ও শিক্ষার প্রসারে প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। মালালার মতো কাজ করতে চাই। ভারতের চিকিৎসকেরা কি আমাকে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দিতে পারেন না?” চিকিৎসা করাতে কলকাতা চলে আসায় পেশোয়ারের সফা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী গুলালই এ বার বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারছে না। ওর বাবা, পেশোয়ারের পাহাড়ীপুর গভর্মেন্ট প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক জাহিদ হুসেন বললেন, “আমাদের দেশে এই রোগ সারবে না। মেয়ের চিকিৎসা করাতে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছি।” মাসে তিরিশ হাজার পাকিস্তানি টাকা (ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে আঠারো হাজার টাকা) বেতন পাওয়া জাহিদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে গুলালই দ্বিতীয় সন্তান।
মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন আর গুলালইয়ের বাবা জাহিদ পুরনো বন্ধু। কন্যার রোগ নিয়ে গত বছর জাহিদ মেল পাঠান ম্যাঞ্চেস্টারে থাকা জিয়াউদ্দিনকে। তার পরেই মালালা সাহায্য চেয়ে যোগাযোগ করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে। ঢাকুরিয়ার ওই হাসপাতালের গ্রুপ সিইও রূপক বড়ুয়া বলেন, “স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির মাধ্যমে সব জেনে আমাদের মনে হয়, পাকিস্তানের রোগাক্রান্ত কিশোরীর জন্য আমাদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। আমরা জানাই, নিখরচায় চিকিৎসা করা হবে, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারও করা হবে।” হাসপাতালের হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রকাশকুমার হাজরা ২৭ ডিসেম্বর মালালাকে চিঠি লিখে জানান, গুলালইয়ের চিকিৎসা করতে তাঁরা প্রস্তুত। এ বছর ১৩ জানুয়ারি মালালা ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লেখে, “আপনারা এগিয়ে আসায় আমি আপ্লুত। গুলালইয়ের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। আমি নিশ্চিত, সেরে উঠলে সমাজের জন্য ও ইতিবাচক অবদান রাখবে।”
এর পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি বাবা-মেয়ে ৪৫ দিনের জন্য ভারতে আসার মেডিক্যাল ভিসা পান। গত ৫ মার্চ পেশোয়ার থেকে বেরিয়ে লাহৌর হয়ে সড়কপথে ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকেন। প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা অবশ্য জানিয়েছেন, ডান দিকের নিলয় থেকে ফুসফুসে রক্ত পৌঁছনোর রাস্তা তৈরি করতে বড়সড় অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কিন্তু অস্ত্রোপচার করার মতো অবস্থা গুলালইয়ের নেই। তা হলে?
পুশতু শব্দ গুলালইয়ের দু’টি অর্থ ফুল ও এমন কিছু, যা আনন্দ দেয়। ফুলের মতো গুলালই কী করে খুশিতে থাকবে, অপরকে আনন্দই বা দেবে কী করে, এখন সেই উদ্বেগে চিকিৎসকেরা।