বাজখাঁই গলা বলল ‘টাচ মি’

যিশুর নাম শুনে শান্ত হলেন পার্থ

বুকের উপর দু’হাত জড়ো করে চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন তিনি। ‘‘পার্থবাবু আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি। শরীর ঠিক আছে তো?’’ প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তার পর উঠে বসে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন গ্রিল দেওয়া জানলার দিকে। ছ’ফুটের উপর লম্বা, রোগা চেহারা। কপালের দিক থেকে পাতলা হয়ে এসেছে চুল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০৩:১২
Share:

পাভলভ মানসিক হাসপাতালে পার্থ দে। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র।

বুকের উপর দু’হাত জড়ো করে চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

‘‘পার্থবাবু আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি। শরীর ঠিক আছে তো?’’ প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তার পর উঠে বসে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন গ্রিল দেওয়া জানলার দিকে।

ছ’ফুটের উপর লম্বা, রোগা চেহারা। কপালের দিক থেকে পাতলা হয়ে এসেছে চুল। মুখে ক্লান্তির ছাপ, দু’চোখের তলায় গাঢ় কালি। পরনে পাভলভ মানসিক হাসপাতালের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট হালকা নীল চেক জামা ও পাজামা। হাত-
পায়ের নখ বহু দিন কাটা হয়নি। লম্বা নখে কালো হয়ে ময়লা জমে রয়েছে। গায়ের চামড়াতেও ময়লার পরত। বহু দিন স্নান না করলে যেমন হয়, অনেকটা সে রকম। দাঁতগুলো হলুদ। ডান পায়ের গোড়ালির উপর ফাইলেরিয়া বা গোদ হয়েছে। সেখানে অনেকটা অংশ ফুলে কালো। দু’পায়ে ফুসকুড়ি ভর্তি। গা থেকে কটু গন্ধ আসছে (চিকিৎসকেরা জানান, প্রথম যখন এসেছিলেন তখন গন্ধে পাশে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। হাসপাতালে স্নানের পরেও গন্ধ যায়নি)।

Advertisement

জানলার সামনে এসেই ভুরু কুঁচকে আচমকা ডান হাতের আঙুল তুলে শূন্যে ‘ক্রস’ চিহ্ন আঁকতে আঁকতে চিৎকার করতে থাকলেন ‘‘ক্রস, ক্রস, ক্রস।’’ এর পর কয়েক সেকেন্ড আর কোনও কথা নেই। তার পরই বাঁ হাত গ্রিলের জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে বার করে বাজখাঁই গলায় নির্দেশ দিলেন, ‘‘টাচ মি, টাচ মি!’’

শুক্রবারের দুপুরের ঘটনা।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ঢোকা গিয়েছিল পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার রাতে এখানেই নিয়ে আসা হয়েছে পার্থ দে-কে। হাসপাতালের পরিচিত মনোবিদ ও চিকিৎসকেরা আগে থেকে বলে রেখেছিলেন, একমাত্র মহিলা মনোবিদ ও মহিলা চিকিৎসকদের সঙ্গেই তিনি একটু-আধটু কথা বলছেন বা তাঁদের কথা শুনছেন। যখনই খুব উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন তখন যিশু বা মা-মেরির কথা বলে তাঁকে শান্ত করা হচ্ছে। তাই পার্থবাবু ‘টাচ মি’ বলে চিৎকার করতেই তাঁকে বলা হল, ‘‘জেসাস অ্যান্ড মাদার মেরি উইল কাম অ্যান্ড টাচ ইউ।’’ দু’-একবার বলার পরে চোখের পাতা বুজে এল তাঁর। চোখ পিট-পিট করতে করতে গলার স্বর নামিয়ে-উঠিয়ে ‘জেসাস, জেসাস’ বলতে বলতে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি।

পাভলভের মূল হাসপাতাল ভবনের গেট দিয়ে ঢুকেই লম্বা করিডর। সেটি পেরিয়ে ডান দিকে ডাইনিং হল-সংলগ্ন একটি ঘরে একা রয়েছেন পার্থবাবু। আসার পর থেকে বারবার ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। দাবি করেছেন, তাঁর কোনও মানসিক সমস্যা নেই। তা হলে কেন মাদার টেরিজার আশ্রমের বদলে তাকে মানসিক রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হল, এই নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন বিস্তর। চিকিৎসক রাজর্ষি গুহঠাকুরতা জানান, পার্থবাবু ক্রমাগত চিৎকার বলে চলেছেন, তাঁকে ঠকিয়ে এখানে আনা হয়েছে। তিনি তো পাগল নন, তা হলে কেন এখানে থাকবেন। এটা তাঁর থাকার জায়গা নয়।

এর মধ্যে এ দিন সকালে আর এক কাণ্ড। পার্থবাবুর কাউন্সেলিংয়ের জন্য তিন জন মহিলা মনোবিদকে পাঠানো হয়েছিল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, পার্থবাবু তাঁদের এক জনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘‘আমি শুধু এঁর সঙ্গে কথা বলব। আপনি ঘরে আসুন।’’ অভিযোগ, ওই মহিলা ঘরে ঢোকার পরেই পার্থবাবু তাঁকে বলেন, ‘‘আপনি আমার সামনে জামাকাপড় খুলে ফেলুন।’’ ওই মনোবিদ পরে বলছিলেন, ‘‘সাইকোসিসের রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এ রকম হয়। তখন কোনও প্রতিক্রিয়া না-দেখিয়ে তাঁদের মনটাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আমিও খুব শান্ত ভাবে ওঁকে বলি, আপনি চোখ বন্ধ করে মা মেরির কথা চিন্তা করুন। তাঁরা আপনার আশপাশেই রয়েছেন। এর পরেই পার্থবাবু ধীরে-ধীরে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যান।’’

হাসপাতালে বিভিন্ন রকমের সাইকোমেট্রি টেস্ট ও রক্তপরীক্ষা করা হচ্ছে পার্থবাবুর। পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ, চিকিৎসক শর্মিলা সরকার, চিকিৎসক অনুপম বারিক ও চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর জন্য একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাঁকে ‘ইনস্টিটিউট অব সায়কিয়াট্রি’তে রেফার করা হতে পারে বলেও স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। পাভলভে যে মহিলা মনোচিকিৎসকের সঙ্গে পার্থ সবচেয়ে বেশিক্ষণ (প্রায় ১৫ মিনিট) কথা বলেছেন, সেই শর্মিলা সরকার জানান, এমনিতে পার্থবাবু কম কথা বলেন। মানসিক ভাবে তিনি কতটা অসুস্থ, তা বুঝতে কয়েক দিন সময় লাগবে। এ দিন বেশির ভাগ কথাই তিনি ইংরেজিতে বলেছেন। কেন এত দিন মৃতদেহ রেখে দিয়েছিলেন জানতে চাওয়া হলে শর্মিলাদেবীকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি দিদিকে আর দিদি আমাকে খুব ভালবাসত। কুকুরদেরও ভালবাসতাম। তাই ওরা মরার পর ওদের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলাম। বাইরের লোক সেটা করতে দেবে না বলে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কাউকে ঢুকতে দিতাম না। কারণ, তা হলে ওদের আমার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হতো।’’ শর্মিলাদেবীকেও পার্থবাবু অভিযোগ করে বলেছেন, পাভলভের পরিবেশ তাঁর একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। ‘‘উনি বলছেন, বাড়িতে সব সময় মন্ত্র বাজত স্পিকারে। তাতে ওঁর শরীরে একটা কম্পন হত, যেটা এখানে এত লোকের মধ্যে হচ্ছে না। এটা উনি সহ্য করতে পারছেন না। বারবার বলছেন, মাদার হাউসে যাবেন।’’

হাসপাতাল সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে পাভলভে আনার পর সারা রাত ঘুমোননি পার্থবাবু। ডাইনিং হলের একটি চেয়ারে বসে ঢুলেছেন। ভোরের দিকে হাসপাতালের আর এক রোগী রঞ্জিত রায় নন্দী ডাইনিং হলে এসে তাঁকে দেখে অবাক হয়ে যান। নতুন মুখ দেখে প্রশ্ন করে বসেন, ‘‘আপনি এখানে এলেন কী করে? আপনাকে তো বেশ রহস্যজনক মনে হচ্ছে!’’
এই কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে চিৎকার শুরু করেন পার্থবাবু। এর পরে কোনও নার্স ভয়ের চোটে অনেক ক্ষণ আর তাঁর ধারকাছে যেতে রাজি হননি। সকালে জলখাবার খেতে চাইছিলেন না। শর্মিলাদেবীর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত খান। কিন্তু দুপুরে ভাতের থালা ছুড়ে ফেলেছেন। অবশেষে বিকেলের পর ওষুধ খেয়ে টানা ঘুমিয়ে চলেছেন। সন্ধের খাবারও খাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন