পিজি-বিআইএন

কোন রোগী কার ভাগে, বিভ্রান্তিতেই বাড়ছে ভোগান্তি

কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না। আর এ ক্ষেত্রে ভাগের রোগী চিকিৎসা পান না! রাজ্যের সেরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম এবং স্নায়ু চিকিৎসার উৎকর্ষ কেন্দ্র বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন)-এর নিজস্ব ভাগাভাগির নিয়মে প্রতি দিন অসংখ্য রোগী জেরবার হচ্ছেন।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৩৬
Share:

—ফাইল চিত্র।

কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না। আর এ ক্ষেত্রে ভাগের রোগী চিকিৎসা পান না!

Advertisement

রাজ্যের সেরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম এবং স্নায়ু চিকিৎসার উৎকর্ষ কেন্দ্র বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন)-এর নিজস্ব ভাগাভাগির নিয়মে প্রতি দিন অসংখ্য রোগী জেরবার হচ্ছেন। কে, কোন ভাগে পড়বেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে চিকিৎসা আটকে থাকছে অনেকেরই। এমনকী, এই টালবাহানায় চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হওয়ায় বহু রোগী মারাও যাচ্ছেন।

এসএসকেএমের ইমার্জেন্সি বিভাগের ঠিক পাশের ঘরেই বিআইএন-এর নিউরোসার্জারি ইমার্জেন্সি। এসএসকেএমের ইমার্জেন্সি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব এসএসকেএমের সুপারের। বিআইএন-এর ইমার্জেন্সি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সেখানকার অধিকর্তার। পদাধিকার বলে যিনি আবার এসএসকেএমেরও অধিকর্তা। এসএসকেএমের ওই বাড়িরই দোতলায় এসএসকেএমের নানা বিভাগের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে বিআইএন-এর নিউরো সার্জারির ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। একতলায় নিউরো সার্জারি ইমার্জেন্সিতে আসা যে রোগীদের ভর্তি করে নেওয়া দরকার হয়ে পড়ে, তাঁরা ঠাঁই পান দোতলার ওই ওয়ার্ডে। এসএসকেএম চত্বরে হলেও ওই ওয়ার্ডও আদতে বিআইএন-এরই অধীন।

Advertisement

কিন্তু সাধারণ রোগীর পক্ষে এই বিভাজনরেখা বোঝার কথা নয়। তাই চিকিৎসা করাতে এসে প্রতি পদে ঠোক্কর খাচ্ছেন তাঁরা। কে, কার অধীনে তা না বুঝে এক বার এই দরজায়, আর এক বার ওই দরজায় হোঁচট খাচ্ছেন তাঁরা। চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ নিয়ে এসএসকেএমের সুপারের দফতরে গেলে সেখানকার কর্মীরা কার্যত হাত তুলে নিচ্ছেন। আর অধিকর্তার দফতের গেলে সেখান থেকেও বলা হচ্ছে, মিশ্র দায়িত্ব, তাই কিছুটা সমস্যা হতেই পারে।

ঠিক যেমনটা হয়েছিল রাজু খাটুয়ার ক্ষেত্রে। গোড়ায় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছিল ৪৫ বছরের রাজুর। বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরে সংক্রমণ হয় তাঁর। সঙ্গে দেখা দেয় আরও নানা জটিলতা। ফের এনআরএসে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে রেফার করে দেওয়া হয় এসএসকেএমে। ভোগান্তি চরমে ওঠে তখনই। এসএসকেএমে পৌঁছনোর পরে সাধারণ ইমার্জেন্সি থেকে তাঁকে পাঠানো হয় নিউরো ইমার্জেন্সিতে। সেখানকার ডাক্তারেরা জানিয়ে দেন, তাঁদের শয্যা নেই। পত্রপাঠ সাধারণ ইমার্জেন্সিতে ফেরত পাঠান তাঁরা। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা রাজুকে এক ধারে শুইয়ে রেখে তাঁর স্ত্রী যখন হাসপাতালের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন, তখনই রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কানে বিষয়টি পৌঁছোয়। তাঁর হস্তক্ষেপে রাজুর ভর্তির ব্যবস্থা হয় ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই। হাসপাতালের ভাগাভাগিতে আটকে থাকে তাঁর চিকিৎসা। নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় জেরবার ওই রোগী আসলে কাদের অধীনে, বিআইএন-এর নাকি, এসএসকেএমের, সেই বিতণ্ডায় কেটে যায় কয়েকটা দিন। কয়েক দিন পরে কার্যত বিনা চিকিৎসাতেই মারা যান রাজু।

পুজোর ঠিক আগের এই ঘটনাটি নিয়ে হাসপাতালে হইচই হয় বিস্তর। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। প্রতি দিন অসংখ্য রোগী হাসপাতালে এসে এমনই অব্যবস্থার শিকার হয়ে চলেছেন। হাসপাতালের সুপার করবী বড়াল কিংবা অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থাও নেননি। এমনকী, এই সমস্যার সমাধানে কী দরকার, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তাঁদের কাছে কোনও সদুত্তরও পাওয়া যায়নি।

সমস্যা এখানেই শেষ নয়। বিআইএন-এর নিউরোসার্জারি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা কোনও রোগীর অস্ত্রোপচারের পরে আইটিইউ-তে স্থানান্তরিত করা প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এসএসকেএমের মেডিসিন বা অ্যানাস্থেশিওলজির আইটিইউ-এ ঠাঁই পাওয়ার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন বাড়ির লোক। কিন্তু সেখানে আবার এসএসকেএমের ডাক্তারদের অধীনে ভর্তি থাকা রোগীদের অগ্রাধিকার। তাই অভিযোগ, বিআইএন-এর রোগী সেখানে খুব বেশি জায়গা পান না।

এসএসকেএমের কর্তারা স্বীকার করেছেন, বিআইএন এবং এসএসকেএম মিলে ঘেঁটে গিয়ে ওই জায়গাটা অনেকটা ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে দড়ি টানাটানির খেলায় চিকিৎসা যে শিকেয় ওঠে বহু ক্ষেত্রেই, তা-ও স্বীকার করে নিয়েছেন ওখানকার চিকিৎসকদের একটি বড় অংশই। নিউরো সার্জারির এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আমরা অর্থাৎ, বিআইএন-এর ডাক্তারেরা অধিকর্তার অধীনে। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, ঠিকার ভিত্তিতে নিয়োগ করা সাফাইকর্মী সকলেই এসএসকেএমের সুপারের অধীনে। তাই কখনও এমনও হয় যে, কিছু ওয়ার্ড এত নোংরা হয় থাকে যে তার জেরেই রোগীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা সব দেখেও কাউকে কিছু বলতে পারি না। বলতে গেলেই শুনতে হয়, ‘আমরা বিআইএন-এর স্টাফ নই’।’’

তা হলে কি এ ভাবেই চলবে বরাবর?

রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘‘সবটাই শুনছি। গোটা ব্যবস্থাটাই আমি ঢেলে সাজব। এ ভাবে চলতে পারে না। সব কিছু থাকা সত্ত্বেও রোগীদের এই নিত্য ভোগান্তি মেনে নেওয়া যায় না। কর্তব্যে গাফিলতি করে কেউ পার পাবেন না।’’

মন্ত্রীর এই আশ্বাস কি আদৌ কাজে পরিণত হবে, প্রশ্ন অসংখ্য অসহায় রোগীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন