রাত-জলসায় লাগাম কই

শব্দবাজি, পুজো প্যান্ডেলে মাইক, গাড়ির হর্ন তো ছিলই। এ সবের সঙ্গে শহরে শব্দদূষণের নতুন উপকরণ এখন পাড়ায় পাড়ায় তারস্বরে মাইক কিংবা সাউন্ডবক্স বাজিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত গানের অনুষ্ঠান বা জলসা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ০৫:৪৩
Share:

তারস্বরে চলছে অনুষ্ঠান। শনিবার মধ্যরাতে, হালতুতে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

চোখ ঝলসে দিচ্ছে হাজার ওয়াটের আলো। সেটা অবশ্য কিছুই নয়। অনেক বেশি আঘাত লাগছে কানে। বিশাল ব়ড় বড় ১৬টি সাউন্ডবক্স বসানো মঞ্চের আশপাশে। মঞ্চে নাচতে নাচতে গাইছেন এক তরুণী। যন্ত্রানুষঙ্গে কয়েক জন। বুকে ধাক্কা মারছে শব্দ। মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। শনিবার রাত তখন ১টা। কসবার হালতু নাজিরবাগান। পুরোদস্তুর আবাসিক তল্লাট। কিন্তু গভীর রাতে ঘুমোতে পারছেন ক’জন বাসিন্দা?

Advertisement

শব্দবাজি, পুজো প্যান্ডেলে মাইক, গাড়ির হর্ন তো ছিলই। এ সবের সঙ্গে শহরে শব্দদূষণের নতুন উপকরণ এখন পাড়ায় পাড়ায় তারস্বরে মাইক কিংবা সাউন্ডবক্স বাজিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত গানের অনুষ্ঠান বা জলসা। যা একটা সময়ে একেবারেই কমে গিয়েছিল। কিন্তু গত দু’-তিন বছরে দাপটের সঙ্গে ফিরে এসেছে কলকাতা ও আশপাশে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী, দেশের কোথাও খোলা জায়গায় রাত ১০টার পরে মাইক, সাউন্ডবক্স বাজানো নিষিদ্ধ। এমনকী, রাত ১০টা পর্যন্তও তা চলার কথা নির্দিষ্ট শব্দসীমা মেনে। সামগ্রিক বিচারে কলকাতা শহরে যে সীমা ৬৫ ডেসিবেল।
কিন্তু পাড়ার জলসায় প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই সে সব নিয়মের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।

Advertisement

স্থানীয়দের অভিযোগ, কসবার নাজিরবাগানের জলসায় রাত ১০টার পরেই তারস্বরে সাউন্ডবক্স বাজতে শুরু করেছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেসিবেল। এ ক্ষেত্রে মাইক, সাউন্ড বক্সের বৈদ্যুতিক সংযোগ খুলে নিয়ে আয়োজকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা পুলিশের। কিন্তু তারা কার্যত হাত গুটিয়ে।

শুধু কসবার নাজিরবাগান নয়, হরিদেবপুরের নস্করপাড়ায় শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত জলসায় মাইক বেজেছে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কসবার মতো সেখানেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

শব্দবাজি যে ফাটাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া গেল না, তার উত্তরে পুলিশ অনেক সময়েই যুক্তি দেয়, কে বাজি ফাটাল, বোঝা যায়নি। কিংবা যখন বাজির শব্দ অনুসরণ করে পৌঁছনো গেল, তখন কাউকে পাওয়া যায়নি। পাড়ার জলসার ক্ষেত্রে তেমনটা হতে পারে না। তা হলে কী যুক্তিতে পুলিশ নিষ্ক্রিয়?

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থানার পুলিশ আধিকারিকেরা বলছেন, ‘‘কেউ অভিযোগ না করলে কী ভাবে ব্যবস্থা নেব?’’ কসবার নাজিরবাগানে অভিযোগ পেলেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

তা ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পুলিশ ছেঁদো যুক্তি দিচ্ছে। কোনও অভিযোগ পাওয়ার দরকার নেই, পুলিশ নিজে থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারে। পথ দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে বা খুন হলে পুলিশ কি অভিযোগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে?’’

কিন্তু বাস্তবটা আলাদা। গত বার বেহালা ও লেক এলাকায় অভিযোগ পাওয়ার পরে তবেই বেশি রাতের জলসা বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ।

এই ধরনের জলসার আগে স্থানীয় থানার অনুমতি নিতে হয়, বড় অনুষ্ঠান হলে খাস লালবাজারে আবেদন করতে হয় আয়োজকদের। আবেদনের ফর্মেই জানাতে হয়, রাত ১০টার পরে মাইক বাজবে না। তার পরেও নিয়ম মানার পরোয়া করছেন না বহু আয়োজক।

পুলিশের একাংশ স্বীকার করছেন, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের জড়তার কারণ, এই ধরনের জলসার আয়োজক সংস্থা বা ক্লাব রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ধন্য।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র অবশ্য বলছেন, ‘‘খোদ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পুলিশের ডিজি ও কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে এই ধরনের শব্দদূষণ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার পরেও পুলিশ ব্যবস্থা নিল না!’’

কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন তথা শাসক দলের নেত্রী মালা রায়ের কথায়, ‘‘এমন শব্দদূষণ ঘটানো মানে আইন লঙ্ঘন করা। সেটা যে-ই করুক, পুলিশকে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন