তারস্বরে: বিসর্জনের শোভাযাত্রায় বাজছে সাউন্ড বক্স। রবিবার, শোভাবাজারের গ্রে স্ট্রিটে। নিজস্ব চিত্র
চোখ ধাঁধানো আলো। সঙ্গে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তিনজোড়া সাউন্ড বক্সের আওয়াজ। অরবিন্দ সরণির উপরে লরির সামনে শুয়ে পড়ে নাচের কায়দায় লুটোপুটি খাচ্ছেন এক যুবক। তাঁকে ঘিরে আরও চার জন। কিছু পরেই পিছন থেকে ছুটে এলেন আরও কয়েক জন যুবক। সকলেরই চলাফেরা অনিয়ন্ত্রিত।
শোভাবাজার স্ট্রিটে ঢোকার মুখে কয়েক মুহূর্ত সব চুপচাপ। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের চওড়া রাস্তা পার করে ফের শুরু হল শব্দের তাণ্ডব। এ বার উদ্দাম নৃত্য এমন পর্যায়ে গেল যে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত পৌঁছেও থামার নাম নেই কারও। পুলিশের কড়া নির্দেশিকার পরেও এ ভাবে তারস্বরে বক্স বাজিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে গঙ্গার ঘাটে। পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে, তবে বক্সের আওয়াজ কম করার বা বন্ধ করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রশ্ন করতে পুজো কমিটির সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য থাকা জোড়াবাগান ট্র্যাফিক গার্ডের এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘বারণ করব কী করে? ডিজে বন্ধ। কিন্তু সাধারণ বক্স বাজানোয় তো কোনও নিষেধ নেই।’’ সেই বক্সের আওয়াজ ৯০ ডেসিবেলের উপরে হলেও না? উত্তর মিলল না সেই পুলিশকর্মীর থেকে।
তবে এ বারও পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় বৈঠকে উচ্চগ্রামের সাউন্ড বক্স বাজানো নিয়ে কড়া নির্দেশিকা দিয়েছে কলকাতা পুলিশ। ভাসানের সময়ে প্রতিমার সঙ্গে উচ্চগ্রামে সাউন্ড বক্স বাজালে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। তবে সেই নির্দেশিকা সব স্তরের আইনরক্ষকদের কাছে পৌঁছেছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল রবিবারের সন্ধ্যার বিভিন্ন বিসর্জন শোভাযাত্রায় শব্দ দানবের দাপট।
বছরের এই সময়টায় সমস্যায় পড়েন বিডন স্ট্রিট, বিধান সরণি এবং অরবিন্দ সরণি লাগোয়া এলাকার বাসিন্দারা। এই পথেই তিন দিন ধরে গঙ্গা অভিমুখে গিয়েছে বহু পাড়া এবং আবাসনের প্রতিমা। অরবিন্দ সরণির অরবিন্দ আবাসনের বাসিন্দা, পেশায় অধ্যাপক সমীর জানা বললেন, ‘‘এই সময়টায় কানে তুলো গুঁজে থাকতে হয়। সারা রাত যত ঠাকুর যাবে তার সঙ্গে তত রকম গানের আওয়াজ। এত জোরে বক্স বাজতে থাকে যে দু’চোখের পাতা এক করা যায় না।’’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, তাঁর মা সত্তরোর্ধ্ব। হৃদ্রোগে আক্রান্ত। পুজোর এই সময়টায় অরবিন্দ সরণির বাড়িতে রাখাই যায় না তাঁকে। বিডন স্ট্রিটের এক বাসিন্দার আবার অভিযোগ, ‘‘যে প্রতিমার ভাসান সেটাই দূরে পিছনের গাড়িতে পড়ে থাকে। সামনে সবাই তারস্বরে গান বাজিয়ে নাচতে নাচতে যায়। ভাসানের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই।’’ উত্তরের মতোই একই অবস্থা হয় বাজে কদমতলা এবং বাবুঘাট চত্বরের কিছু সরকারি আবাসনের বাসিন্দাদের।
কাশী বোস লেন পুজো কমিটির কর্তা সোমেন দত্তের বক্তব্য, ‘‘কড়া আইনের পাশাপাশি পুজো উদ্যোক্তাদেরও সচেতন হওয়া উচিত। বিসর্জন মানে তাণ্ডব নৃত্য নয়।’’ ত্রিধারা পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার বলেন, ‘‘২৩ অক্টোবর কার্নিভালের পরে আমাদের ভাসান। কোনও ধরনের শব্দ তাণ্ডবে নেই আমরা। এ ভাবে ভাসান দেওয়া অপরাধ। পুজো কমিটিগুলিকে সচেতন হতে বলব।’’ কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বললেন, ‘‘বেশির ভাগ বড় পুজো কমিটির ভাসান এখনও বাকি। মাত্রাছাড়া আওয়াজে বক্স বাজাতে দেখা গেলেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’