সেপসিস হওয়া নিয়ে সংশয় চিকিৎসকদের, আটকে রইল অঙ্গদান

একুশ বছরের এক যুবকের মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে তাঁর অঙ্গ দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিবার। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। স্বাস্থ্য দফতরকে তাঁরা জানিয়েও দিয়েছিলেন নিজেদের সম্মতির কথা।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৬
Share:

একুশ বছরের এক যুবকের মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে তাঁর অঙ্গ দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিবার। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। স্বাস্থ্য দফতরকে তাঁরা জানিয়েও দিয়েছিলেন নিজেদের সম্মতির কথা। খানিক গড়িমসির পরে স্বাস্থ্য দফতর বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে ওই যুবকের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণা করেছিল মঙ্গলবার রাতে। কিন্তু বৃহস্পতিবারও ওই যুবকের বাড়ির লোক জানতে পারলেন না, আদৌ সেই অঙ্গদান সম্ভব হবে কি না!

Advertisement

কারণ, স্বাস্থ্য দফতর মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘোষণা করে দিয়েছিল, মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়া যুবকের দেহের রক্ত পরীক্ষা করে ‘সেপসিস’ পাওয়া গিয়েছে। তাই তাঁর অঙ্গ নেওয়া যাবে না। তার পরে সেই স্বাস্থ্য দফতরই ‘আর একটু ভাল করে সব কিছু পরীক্ষা করতে হবে’ বলে প্রায় দু’দিন ধরে সেই দেহ রেখে দিয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে আইটিইউ-এর ভেন্টিলেশনে। স্বাস্থ্যকর্তাদের এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করলেই উত্তর মিলেছে, ‘‘আলোচনা চলছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’’

এখন প্রশ্ন হল, সিদ্ধান্ত কবে নেওয়া হবে? কত দিন অপেক্ষা করবে ওই যুবকের পরিবার?

Advertisement

চিকিৎসকেরা বলছেন, রক্তে সেপসিস পাওয়া গেলে সেই দেহ থেকে অঙ্গ নেওয়া যায় না। তা হলে আর আলোচনা কীসের? ওই যুবকের বিধ্বস্ত, বিভ্রান্ত আত্মীয়-পরিজনেদের প্রশ্ন, ‘‘আর কত দিন এমন টানাপড়েন চলবে? এখন তো মনে হচ্ছে, অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিয়েই ভুল হয়েছে।’’ তাঁদের আরও প্রশ্ন, ‘‘এখন যদি সরকার জানায় যে, অঙ্গ আর নেওয়া যাবে না, তখন কি আমরা দেহের সৎকার করতে পারব? নাকি তখন ভেন্টিলেটর বন্ধ করা যাবে কি যাবে না, সেই নীতিগত প্রশ্ন এসে উপস্থিত হবে? তখন মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়া এই রোগীকে নিয়ে কী করব?’’

গ্রিন করিডর করে আনা হয়েছিল কৌশিকের দেহ। — দীপঙ্কর মজুমদার

গত রবিবার, ৬ নভেম্বর রাত একটা নাগাদ হাওড়ার আলমপুরের কাছে পথ-দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন সাঁকরাইলের পোদরা অঞ্চলের বাসিন্দা কৌশিক সরকার। দু’তিনটি হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কৌশিকের মামা অশোক কোলে জানান, মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ পরিবার মরণোত্তর অঙ্গদানের কথা ভাবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। টানা কয়েক ঘণ্টার ছোটাছুটি ও ফোনে কথাবার্তার পরে স্বাস্থ্য দফতরের একটি বিশেষ দল ওই বেসরকারি হাসপাতালে যায়। কৌশিকের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণার পরে মঙ্গলবার গভীর রাতে গ্রিন করিডর তৈরি করে তাঁকে বিশেষ ভেন্টিলেটরযুক্ত অ্যাম্বুল্যান্সে এসএসকেএম হাসপাতালেও আনা হয় অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য।

স্বাস্থ্য দফতরের অঙ্গদান বিষয়ক নোডাল অফিসার অদিতিকিশোর সরকার ওই রাতেই ঘোষণা করেন, যুবকের রক্ত পরীক্ষা করে সেপসিসের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর অঙ্গ নেওয়া যাবে না (তাঁর ঘোষণার ভাষা ছিল— ‘ইন দিস কেস ট্রান্সপ্লান্টেশন ইজ কনট্রাইন্ডিকেটেড’)। এর কিছু পরে আবার তাঁরা কৌশিককে এসএসকেএমের ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে দিয়ে জানান, আরও কিছু পরীক্ষা ছাড়া চূড়ান্ত কোনও রায় দেওয়া যাবে না।

তার পরেও প্রায় দু’দিন কেটে গিয়েছে। পরিস্থিতি একই জায়গায় থমকে। স্বাস্থ্য দফতর আর রা কাড়ছে না। অথৈ জলে পড়েছে ওই যুবকের পরিবার। বৃহস্পতিবার অদিতিকিশোরবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তাঁর বক্তব্য, ‘‘একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে কৌশিককে পরীক্ষা করানো হয়েছে। তাঁরাও মনে করছেন, সেপসিসের পরিমাণ বেশ বেশি। তাই হয়তো এখন আর অঙ্গ নেওয়া হবে না। আপনা থেকে তাঁর হৃৎযন্ত্র যখন থেমে যাবে, তখন তাঁর চোখ আর ত্বক নেওয়া হতে পারে।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, সেই ত্বক বা চোখ থেকে সংক্রমণ ছড়াবে না গ্রহীতার? অদিতিবাবুর দ্বিধাগ্রস্ত উত্তর, ‘‘হতেও পারে, না-ও হতে পারে। তখন সেটা ডাক্তারবাবুরা ঠিক করবেন।’’ অর্থাৎ, পুরোটাই অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে স্বাস্থ্য দফতর।’’

মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়া কোনও রোগীর দেহে এক বার সেপসিস দেখা দিলে সেই সেপসিস সারিয়ে কি অঙ্গ নেওয়া যায়? এসএসকেএমের অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কে বলেছে ওঁর সেপসিস হয়েছে? আমি শুধু জানি, ওঁর ক্রিয়েটিনিন বেশি রয়েছে। সেটা কমানোর চেষ্টা চলছে।’’ অদিতিকিশোরবাবু ওই যুবকের সেপসিস হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন শুনে একটু থমকে মঞ্জুদেবীর উক্তি, ‘‘সেপসিসের ব্যাপারে আমি কিছু
জানি না।’’

কৌশিকের কাকা দীপক পানের দাবি, যে দিন থেকে তাঁরা অঙ্গদানের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন, সে দিন থেকেই তাঁদের নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। প্রথমে হাওড়ার যে বেসরকারি হাসপাতালে কৌশিক ভেন্টিলেশনে ছিলেন, সেখানকার কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত হুমকি দিয়েছেন যে, তাঁদের সব টাকা তৎক্ষণাৎ মিটিয়ে না দিলে ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দেওয়া হবে। তা হলে সব অঙ্গ নষ্ট হয়ে যাবে এবং তা আর দানের যোগ্য থাকবে না। শেষ পর্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বলিয়ে হাসপাতালকে নিরস্ত করা হয়। ওই হাসপাতালের প্রধান প্রদীপকুমার পাটোয়া-র যুক্তি, ‘‘হাসপাতাল তো টাকা চাইবেই। তবে ভেন্টিলেটর বন্ধ করা হয়নি। আমি এসে সব মিটিয়ে দিয়েছি।’’

কৌশিকের মামা অশোক কোলের আরও অভিযোগ, মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন অফিসারের নাম করে তাঁদের মোবাইলে ফোন আসতে থাকে। ওই ব্যক্তিরা কলকাতার বিশেষ একটি বেসরকারি হাসপাতালের নাম করে বলতে থাকেন, লিভারটি যেন ওখানেই দান করা হয়।

তাঁদের আরও অভিযোগ, এসএসকেএমে আসার পরেও অধ্যক্ষের দেখা না পেয়ে তাঁদের ঠায় বসে থাকতে হয়। কী ভাবে অঙ্গদান প্রক্রিয়া হবে, সে বিষয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা এসএসকেএমের অধ্যক্ষ মঞ্জুদেবী বা অদিতিকিশোরবাবুর কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাননি। পরে এক মন্ত্রী মারফত স্বাস্থ্য ভবনে যোগাযোগ করা হলে সবাই নড়েচড়ে বসেন। মঞ্জুদেবীও বাড়ি থেকে হাসপাতালে ফিরে এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। নিজেদের এই হেনস্থার কথা সবিস্তার জানিয়ে ইতিমধ্যে তাঁরা এসএসকেএম ও স্বাস্থ্য ভবনে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। স্বাস্থ্য ভবনের বিভিন্ন অফিসারের নাম করে যে নম্বরগুলি থেকে তাঁদের কাছে ফোন এসেছে, সেই নম্বরগুলিও জমা দিয়েছেন। মঞ্জুদেবী এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি। আর অদিতিবাবু বলেন, ‘‘একটি বেসরকারি হাসপাতালে সংগৃহীত অঙ্গগুলি দিতে হবে বলে প্রচুর গুজব ছড়িয়েছিল। এতে আমাদেরও কাজ করতে খানিক দেরি হয়ে যায়।’’

স্বাস্থ্য ভবনের একাধিক অফিসার ও কর্তাদের অবশ্য দাবি, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বার হওয়ার আশঙ্কা আছে। অঙ্গদান নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের এই ছন্নছাড়া ভূমিকার পিছনে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে সংগৃহীত অঙ্গ দেওয়ার চাপ কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। অঙ্গদান নিয়ে প্রচার সত্ত্বেও স্বাস্থ্য দফতর আদৌ পরিকাঠামোগত ভাবে কতটা সক্ষম, অঙ্গ গ্রহীতাদের তালিকাও তাদের কাছে কতটা তৈরি, তা নিয়েও এ বার তদন্ত করা উচিত বলে তাঁরা মনে করছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন