প্রযুক্তির ভিড়ে ফিকে হচ্ছে কি হালখাতার রং

বছর শুরুর হালখাতার উৎসবের কথা মনে করলেই চোখে ভেসে উঠবে লাল সালু মোড়ানো মোটা হিসেবের খাতা। পরবর্তী সময়ে যে কাজে লাল কাগজ সাঁটা খাতাও ব্যবহার করা হত।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৫৬
Share:

স্তূপাকৃতি: খদ্দেরের আশায় এক হালখাতা ব্যবসায়ী। বৈঠকখানা বাজারে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

হারাতে বসল কি হালখাতার গুরুত্ব?

Advertisement

এক সময়ে নতুন বছর শুরুর উৎসবের কেন্দ্রে থাকত লাল রঙের হিসেবের খাতা। কিন্তু সেই খাতা ঘিরে হইচই যেন কমই চোখে পড়ে ইদানীং। প্রযুক্তির দাপটেই কি দিন দিন গুরুত্ব হারাচ্ছে সেই চল? বড়বাজারে হিসেবের খাতার পাইকারি ব্যবসায়ী থেকে শিয়ালদহের সেই খাতা তৈরির কারখানার মালিক, সকলের মত তেমনই। সাহিত্যিক-সমাজতত্ত্ববিদেরাও এ বিষয়ে একমত। হিসেবের খাতার জায়গা নিয়ে নিয়েছে কম্পিউটার!

বছর শুরুর হালখাতার উৎসবের কথা মনে করলেই চোখে ভেসে উঠবে লাল সালু মোড়ানো মোটা হিসেবের খাতা। পরবর্তী সময়ে যে কাজে লাল কাগজ সাঁটা খাতাও ব্যবহার করা হত। মুর্শিদ কুলি খান বাংলার নতুন নবাব হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আসার পরে এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতার উৎসব শুরু হয়। হাওড়া শিবপুর দীনবন্ধু কলেজের শিক্ষক সায়ন্তন দাস বলছিলেন, ‘‘হাল মানে নতুন। নতুন বছরের ব্যবসার খাতায় নাম তোলার প্রক্রিয়াকে হালখাতা বলা হত সেই নবাবের সময় থেকে। পরে হিসেবের সেই লাল খাতাটিই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত হয়ে যায়।’’ বছর শুরুর আগে সেই লাল খাতাই কেনার ভিড় জমত বড়বাজারের অলিগলিতে।

Advertisement

এপ্রিলের এক ব্যস্ত দুপুরে বড়বাজারের সোনাপট্টিতে সেই খাতার পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা গেল, গুটিকয়েক দোকানে চলছে কেনাবেচা। মহাত্মা গাঁধী রোডের পাশে প্রায় নব্বই বছরের পারিবারিক ব্যবসা গোবিন্দ সাহাদের। গোবিন্দবাবুর কথায়, ‘‘নববর্ষের সপ্তাহ খানেক আগে থেকে ভিড়ের চাপে কথা বলার সুযোগও পেতাম না। বছর পাঁচেক ধরে কম্পিউটারের দৌলতে আমাদের ব্যবসা খুবই কমে গিয়েছে। এখন সারা বছর বিভিন্ন রকমের খাতা বিক্রি করে কোনও রকমে ব্যবসা চলছে।’’ শেওড়াফুলি থেকে নতুন বছরের খাতা কিনতে এসেছিলেন ওম সিংহ। শেওড়াফুলিতে বইখাতার দোকান আছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘এক সময়ে পয়লা বৈশাখের আগে প্রায় পাঁচশো খাতা কিনতাম। এ বার মাত্র একশোটি নিলাম।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বড়বাজারের অন্যান্য খাতা বিক্রেতারও একই হাল। আশি বছরের পুরনো দোকান অনাদিনাথ দত্তের। অনাদিবাবুর কথায়, ‘‘হালখাতার জন্য লাল সালুতে বাঁধা টালিখাতা ব্যবহার করা হত। কিন্তু এখন ওই খাতার আর বিক্রি নেই বললেই চলে। সাধারণ লাইন টানা খাতা কিনে নিয়ে যান অনেকে।’’ আর এক ব্যবসায়ী অনুপকুমার দাঁর কথায়, ‘‘এখন বেশির ভাগ ক্রেতা শুধু পুজো দেওয়ার জন্যই খাতা কেনেন।’’ হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা পেশায় চিকিৎসক দেবাঞ্জন শাসমল খাতা কিনতে এসেছিলেন বড়বাজারে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ওষুধের দোকানে কম্পিউটারেই হিসেব করি। পুজোর জন্য খাতা কিনতে এসেছি।’’

হিসেবের খাতা তৈরির একাধিক কারখানা রয়েছে শিয়ালদহের বৈঠকখানা রোডে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সেখানে কারখানা চালাচ্ছেন মতিয়ার রহমান। মতিয়ারের কথায়, ‘‘আগে কালীপুজোর পর থেকেই নববর্ষের খাতা তৈরির কাজ শুরু হত। এখন নববর্ষের মাস দেড়েক আগে কাজ শুরু করি।’’ বিভিন্ন ধরনের খাতা বাঁধানোর পাশাপাশি হিসেবের খাতা তৈরির চারটি কারখানা ছিল নুর আলম খানের। নুরসাহেবের চার পুত্রের নামে চারটি কারখানা ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘কম্পিউটারের রমরমার জন্য তিনটি কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।’’

তবে হিসেবের খাতা ব্যবহারের চল কমে যাওয়া নিয়ে আফশোস করতে নারাজ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শীষের্ন্দুবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘আমি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ভালবাসি। এখন কম্পিউটারেই মানুষ বেশি স্বচ্ছন্দ। আমি নিজেও ল্যাপটপে

লিখি। হালখাতা উৎসবটা হারিয়ে যাবে, সে কথা ঠিক নয়। প্রতীক হিসেবে খাতাটা থাকবে। প্রযুক্তির যুগে পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে।’’ কবি জয় গোস্বামীর বক্তব্যও তেমনই। তাঁর কথায়, ‘‘এখন কম্পিউটারেই মানুষ বেশি সিদ্ধহস্ত। সাহিত্যিকেরাও কম্পিউটারে লেখেন। কম্পিউটারের জন্য হিসেবের খাতা হারিয়ে গেলেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদের দিকটি স্পষ্ট।’’ সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র মনে করেন, ‘‘এমন একটা দিন আসবে, মানুষ যখন কম্পিউটারকে পুজো করে নববর্ষ পালন করবেন। তখন হিসেবের খাতা জাদুঘরে ঠাঁই পাবে!’’ তবে লেখিকা মীরাতুন নাহারের বক্তব্য, হালখাতা ঘিরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হত। ‘‘এখন সেইটাও যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে,’’ বলেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন