বন্দির মুখ ঢাকতে ওয়াড় কিনতে হয় পুলিশকেই 

মধ্য কলকাতার এক থানার লকআপের সামনে জোর তৎপরতা। যৌন হেনস্থায় অভিযুক্তকে আদালতে তুলতে হবে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:৫৫
Share:

মুখ ঢাকতে ভরসা বালিশের ওয়াড়। ফাইল চিত্র

মধ্য কলকাতার এক থানার লকআপের সামনে জোর তৎপরতা। যৌন হেনস্থায় অভিযুক্তকে আদালতে তুলতে হবে।

Advertisement

মোটা খাতা বগলদাবা করে সামনে হাঁটু মুড়ে বসা এক অভিযুক্তকে দেখিয়ে ‘কোর্ট বাবু’ বলতে শুরু করেছেন, ‘‘ওরে কেউ এর মুখ ঢাক। বাইরে প্রচুর লোক। মাঙ্কিটুপি, গামছা, কাপড়, যা পারিস নিয়ে আয়।’’ বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরেও হাতের কাছে কিছু না পেয়ে এর পরে ‘কোর্ট বাবু’র চিৎকার, ‘‘বালিশের ওয়াড়গুলো কোথায় যায়? আমার টেবিলের উপরে কালো একটা প্লাস্টিক আছে। তাতে দু’টো ফুটো করে নিয়ে আয়, ওতেই হবে!’’

উত্তর কলকাতায় এক থানায় অভিযুক্তকে কোর্টে পেশ করার আগে আবার মুখ ঢাকার তেমন তৎপরতাই দেখা যায়নি। অভিযুক্ত এ দিকে পুলিশকে বলেই চলেছেন, ‘‘স্যর আমাকে কিছু একটা দিন, মুখটা ঢাকি। বাইরে লোক ভর্তি।’’ ধমক দিয়ে পুলিশকর্মীর জবাব, ‘‘চুপ! তোমার ও সব লাগবে না।’’ পণের দাবিতে স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগ ছিল যুবকের বিরুদ্ধে। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আত্মঘাতী হন সেই স্ত্রী। এর পরেই শ্বশুরবাড়ির অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় ওই যুবককে।

Advertisement

পুলিশ জানাচ্ছে, মামলা এবং অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে থানা থেকে মুখ ঢেকে অভিযুক্তকে কোর্টে পাঠানো হয়। এ জন্য বছরের শুরুতে থানায় থানায় বালিশের ওয়াড় যায়। সাদা বা খাকি পোশাকের পাশাপাশি এই ধরনের ওয়াড়গুলিও তৈরি হয় পুলিশের ‘সেন্ট্রাল ক্লোদিং রুম’-এ। ওয়াড়গুলি পরে যাতে দেখতে পায় বন্দি, তাই অনেক সময়ে তাতে ছিদ্রও করা থাকে। তবে অনেক থানাই জানাচ্ছে, ওই সব ওয়াড় আসার অপেক্ষা করে না তারা। কোনও কোনও থানা আলাদা ভাবে লোক পাঠিয়ে বালিশের ওয়াড় কিনে আনে হাওড়ার বাঁধাঘাট থেকে, কখনও আবার থানার সামনেই লোক ডাকিয়ে ওয়াড় বানানো হয়। খরচ পড়ে ওয়াড় পিছু ২০ টাকা। সকলের একটাই চিন্তা, প্রয়োজনের সময়ে যেন সমস্যা না হয়। প্রয়োজনের সময়ে যেন

প্লাস্টিক, মাঙ্কিটুপির খোঁজ করে দেরি না হয় কাজে।

অনেক সময়ে থানার চাপ অভিযুক্তদের বাড়ির লোকজনই অনেকটা কমিয়ে দেন বলে জানাচ্ছে পুলিশ। বাড়ি থেকে আনা খাবার, পোশাকের পাশাপাশি বালিশের

ওয়াড় কিংবা মুখ ঢাকার জন্য গামছা দিয়ে যান তাঁরাই।

নিজেদেরই ওয়াড়ের ব্যবস্থা করতে হয় কেন?

ইস্টার্ন সাবআর্বান ডিভিশনের একটি থানার আধিকারিক বলেন, ‘‘অত সময় নেই। বালিশের ওয়াড়ের জন্য আবার রিকুইজিশন দিতে হবে। তাই গামছা বা কাপড়েই কাজ সেরে নিই।’’ নর্থ ডিভিশনের এক থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক আবার বলেন, ‘‘বাইপাসের ধারের থানায় থাকাকালীন এক বার সমস্যায় পড়েছিলাম। তড়িঘড়ি থানার লোকের মাঙ্কিটুপি পরিয়ে কোর্টে পাঠাতে হয়েছিল। তার পরে আমিই লোক পাঠিয়ে হাওড়ার বাঁধাঘাঁট থেকে ১০০টা ওয়াড় কিনিয়ে আনি।’’ নর্থ ডিভিশনের এক থানার আধিকারিক আবার দাবি করলেন, ‘‘আমরা ওয়াড় শেষ হয়ে গেলেই রিকুইজিশন দিই। প্লাস্টিক বা কাপড়ে মুখ ঢেকে নিয়ে গেলে অনেকেই বলতে পারেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।’’

থানার মতো তাঁদের ওয়াড় নিয়ে ‘জ্বালা’ নেই বলে জানাচ্ছেন জেল আধিকারিকেরা। বারুইপুর জেলের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পুলিশি হেফাজতের সময়ের দু’-এক বার ওয়াড় লাগে। আমাদের কাছে এসেছেন মানে, বেশির ভাগেরই জেল হেফাজত হয়েছে। ততদিনে তাঁরা চেনা বামুন।’’ শিয়ালদহ আদালতের সরকারি আইনজীবী অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মূলত যে অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে প্রত্যক্ষদর্শীর বা অভিযোগকারীর শনাক্ত করার ব্যাপার থাকে, সে ক্ষেত্রেই মুখ ঢাকা হয়। অন্যথায় অভিযুক্তের আইনজীবী আদালতে বলতে পারেন, শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ঠিক হয়নি। অভিযুক্তের ছবি বাইরে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। তাতে প্রভাবিত হয়েছেন শনাক্তকারী।’’ এক পুলিশ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘কে ঝুঁকি নেবে? তার থেকে মুখ ঢেকে নিয়ে যাওয়াই ভাল।’’

কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের এক আধিকারিক আবার বললেন, ‘‘আমরা যাঁদের ধরি,

তাঁদের পরিচয় গোপন রাখা খুব জরুরি। জঙ্গি মডিউলে জড়িত এক জনকে ধরার পরে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, সব বলবেন, শুধু কোর্টে নিয়ে যেতে হবে মুখ ঢেকে!’’

শর্ত মানা হয়েছিল? আধিকারিক বলেন, ‘‘বলেছিলাম, জঙ্গির মুখ না দেখানোই ভাল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন