প্রকাশ্য বিদ্রোহটা শেষ পর্যন্ত টিকলো না। কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ক্ষোভের আগুনটা নিভল কি!
শনিবার পুরভোটের গোলমালে গিরিশ পার্ক থানার সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে পুলিশের নিচু ও মাঝারি তলায় ক্ষোভের একটা বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল। শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী হওয়ায় সেটা প্রকাশ্য বিদ্রোহের চেহারা নেয়নি। বদলে শনিবার রাত থেকে সোশ্যাল নেটওয়াির্কং সাইটে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন পুলিশ অফিসারেরা। রবিবারও দিনভর তা চলেছে।
ফেসবুকের সেই দেওয়াল লিখনগুলো বদলে গেল সোমবার সকাল হতেই! সোমবার সকালেই খবরটি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেন পুলিশকর্তারা। এর পরেই দেখা যায়, নিজেদের মন্তব্য ফেসবুকের ‘ওয়াল’ থেকে মুছে দিয়েছেন অধিকাংশ পুলিশ! কেউ কেউ বদলে নিয়েছেন প্রতিবাদের ভাষাও!
কেন এই বদল? লালবাজারের অন্দরের খবর, অফিসারদের ক্ষোভের কথা চাউর হতেই এ দিন সকাল থেকে ফেসবুকে মন্তব্য করা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। তার পরেই একে একে মন্তব্য মুছে দেওয়া শুরু হয়! যদিও বাহিনীর একাংশের বক্তব্য, অল্প সময়ের জন্য হলেও এই প্রতিবাদ লালবাজারে বড় ধাক্কা দিয়েছে। তাই এ দিন তড়িঘড়ি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে আসরে নামতে হয় কলকাতার দাপুটে আইপিএস-দের।
যদিও লালবাজারের শীর্ষ কর্তাদের অনেকেই বাহিনীর অন্দরে ক্ষোভের কথা মানতে নারাজ। শাসক দল তথা রাজ্য সরকারের তরফেও পুলিশের ক্ষোভের কথা মানা হয়নি। সোমবার নদিয়ায় এক নির্বাচনী জনসভার পরে তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘কোথাও তো বিদ্রোহ হয়নি! ফেসবুকে? সে আর ক’জন দেখে!’’ এক আইপিএস-ও বলেন, ‘‘বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তাঁদের ক্ষোভ বাহিনীর শীর্ষ কর্তা বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাই পুলিশে কোনও সঙ্কট দেখছি না। ওদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হবে না।’’ অন্য এক আইপিএস অফিসার জানান, ওই পোস্টে সরকার-বিরোধী কোনও কথা না থাকায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ টিকত না। একই সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘তবে এখন সবই সম্ভব!’’
লালবাজার সূত্রের খবর, বাহিনীর কর্তারা বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে কথা বলার পর অনেকেই সেটিকে সতর্কবার্তা হিসেবে ধরেছেন। ফেসবুকে মন্তব্য মুছে ফেলা এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘চাকরি করি। তাই জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করাটা ঠিক হবে না।’’
লালবাজারের একাংশ বলছেন, পুলিশে থেকে শাসক দল বা উঁচু তলার নির্দেশের বিরোধিতা করে টিকে থাকা যায় না। যার প্রমাণ, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেন। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড খোদ মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা’ বলা সত্ত্বেও দময়ন্তীর নেতৃত্বাধীন গোয়েন্দারা অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর কথার বিরুদ্ধে গিয়েই দময়ন্তী সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘ধর্ষণ হয়েছে।’’ পরে মহাকরণে গিয়ে সেই দময়ন্তীকেই বলতে হয়, তদন্তের সঙ্গে সরকার বা শাসক দলের বিরোধিতা নেই! যদিও তার পরেও তাঁকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়। রাজ্যের দুঁদে আইপিএস-রা বলছেন, দময়ন্তীর মতো অফিসার যখন বিদ্রোহ টিকিয়ে রাখতে পারলেন না, তখন ওসি বা এসআই-এর মতো সাধারণ অফিসারেরা তা জিইয়ে রাখবেন কোন ভরসায়!
এই প্রসঙ্গেই লালবাজারের এক পদস্থ কর্তা মনে করিয়ে দিয়েছেন গার্ডেনরিচে তাপস চৌধুরী খুনের কথা। সে দিন ঘটনার পরেই দোষীদের আড়াল করতে তৎপর হয়েছিলেন খোদ লালবাজারের এক আইপিএস অফিসার। তাঁর সঙ্গে শাসক দলের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত। তাপস চৌধুরীর ঘটনায় এফআইআর লেখার সময় সেই আইপিএস-ই নানা ভাবে হোমিসাইড শাখার অফিসারদের বাধা দিচ্ছিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এক গোয়েন্দা। পরিস্থিতি সামলান লালবাজারের সেই সময়ের এক কর্তা। তাপস চৌধুরীর ঘটনা পরে সিআইডি-র হাতে চলে গিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ সেই আইপিএস এখনও লালবাজারে বহাল তবিয়তে রয়েছেন! ‘‘গার্ডেনরিচ কাণ্ডে বাহিনীর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বদলি হলেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। কিন্তু সেই অফিসারের কিছুই হল না! তা হলেই বুঝুন, বিদ্রোহের ভবিষ্যৎ কী!’’ বলছেন এক পুলিশকর্তা। একই ভাবে শাসক দলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুখ খুলে বদলি হতে হয়েছিল বীরভূমের প্রাক্তন এসপি অলোক রাজোরিয়াকে। তা হলে কি কলকাতা পুলিশের এই বিদ্রোহ দানা বাঁধার আগেই হাওয়া হয়ে গেল?
লালবাজারের অনেক অফিসার বলেছেন, ফেসবুক থেকে সরে গেলেও ক্ষোভের আগুনটা রয়েই গিয়েছে। এখন তা শুরু হয়েছে অফিসারদের নিজেদের ‘হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপ’-এ। পথেঘাটে সহকর্মী-বন্ধুদের কাছেও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন অনেকে।
লালবাজারের একটা বড় অংশ বলছেন, পুলিশের অন্দরে এই ক্ষোভ নতুন নয়। তাপস চৌধুরীর খুন বা আলিপুরে থানার ভিতরে বসে বসে মার খাওয়া— নানা ঘটনায় বহু দিন ধরেই পুলিশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁরা বলছেন, ক’দিন আগেই শহরের একটি থানায় ওসি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ভোটে শাসক দলের হয়ে কাজ করতে হবে। কনস্টেবল এবং অন্য কয়েক জন অফিসার ওসি-কে জানান, তাঁরা এ ভাবে কাজ করতে পারবেন না। ভোটের আগে শহরের দুষ্কৃতীদের তালিকা ধরে গ্রেফতারের অনুমতি চান এক গোয়েন্দা অফিসার। কিন্তু লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা সেই অনুমতি দেননি। সে দিন মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি আপাত-শান্ত ওই অফিসার! জগন্নাথ মণ্ডলের ঘটনার পরে এই সব মিলিত ক্ষোভই ছিটকে বেরিয়ে এসেছে।
এ সব তথ্য কি লালবাজারের শীর্ষ কর্তাদের কানে যায় না? তা হলে তাঁরা সঙ্কট না থাকার কথা বলছেন কী করে? লালবাজারের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ বলছেন, ফেসবুকে যাঁরা সরব হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই সিকি শতকের উপর কলকাতা পুলিশে কাজ করে ফেলেছেন। এঁদের সঙ্গে কথা বলে কর্তারা মনে করছেন, ‘‘এই অফিসারেরা ফোঁস করলেও ছোবল মারবেন না!’’ এক কর্তার বক্তব্য, ‘ভাল’ এলাকায় পোস্টিং বা থানার ওসি-র চেয়ারে বসে সব অফিসারই যে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ধরে রেখেছেন, এমনটা নয়। তাঁদের নানা ‘কাজকর্মে’র কথা কর্তারা জানেন। অনেকেই বলছেন, পুলিশ শাসক দলের তাঁবেদারি করছে, এমন ঘটনা ওই অফিসারেরা আগেও দেখেছেন। এখন সহকর্মী আক্রান্ত হওয়ায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেলেছেন।
যদিও তাতে সবটুকু ধামাচাপা দেওয়া যাচ্ছে না। তিন দফায় কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করে যাওয়া এক প্রবীণ আইপিএস বলেছেন, ‘‘অফিসারেরা নিজেদের প্রোফাইল থেকে এমন পোস্ট করেছেন। তা হলে কতটা ক্ষোভ জমেছে, বোঝা উচিত। কলকাতা পুলিশের জন্য আমার খারাপ লাগছে।’’ বাহিনীর অন্দরে অনেক তরুণ অফিসারও ক্ষুব্ধ। তাঁদের কেউ ২০০৮ সালে কেউ ২০১০ সালে কাজে যোগ দিয়েছেন। তরুণদের ক্ষোভ নিয়ে কী ভাবছেন লালবাজারের কর্তারা? কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, ‘‘ওরা এখন পুলিশি ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে ওঠেনি। তাই এমন করছে। তা ছাড়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাতেও ওরা এখন নেই। আরও অভিজ্ঞতা বাড়লে এই সমস্যা থাকবে না।’’ যদিও কলকাতা পুলিশের এক ইনস্পেক্টর বলছেন, ‘‘পুলিশি ব্যবস্থায় মানিয়ে নেওয়াটাই আমাদের বড় সমস্যা হয়েছে!’’
তরুণ অফিসারেরা কী বলছেন?
‘‘গুলিটা আমার গায়ে লাগতে ভাল হতো! অন্তত পরিবারকে বোঝাতে পারতাম, আমি সৎ ভাবে কাজ করি,’’ এক তরুণ অফিসারের মেসেজ তাঁর বন্ধুকে।