দরাজ হাতেই পুজোর ‘দাদাগিরি’

সবাই তো দাদা পেতে চায়। কেউ দাদা পায়, কেউ পায় না। পুজোর বৈতরণী পেরোতে দাদারাই এখন কার্যত ছাতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন শহরের পুজো কমিটিগুলির কাছে। সেই দাদাদের অধিকাংশই আবার রাজনীতির ময়দানের নামী খেলুড়ে। কখনও তিনি মন্ত্রীর ভূমিকায়, কখনও বা মেয়র পারিষদ। যার ছাতা যত বড়, তিনি তত বেশি পুজোর মাথায়।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৫১
Share:

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

সবাই তো দাদা পেতে চায়। কেউ দাদা পায়, কেউ পায় না।

Advertisement

পুজোর বৈতরণী পেরোতে দাদারাই এখন কার্যত ছাতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন শহরের পুজো কমিটিগুলির কাছে। সেই দাদাদের অধিকাংশই আবার রাজনীতির ময়দানের নামী খেলুড়ে। কখনও তিনি মন্ত্রীর ভূমিকায়, কখনও বা মেয়র পারিষদ। যার ছাতা যত বড়, তিনি তত বেশি পুজোর মাথায়। ছাতার গুণে কোনও পুজো ‘দাদা’র পুজোই হয়ে ওঠে, কোনও পুজোয় আবার সেই দাদাই থাকেন ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র ঢঙে। তবে পুজোকর্তারা বলছেন, সক্রিয় থাকুন বা না-ই থাকুন, স্পনসর জোগাড় করা হোক বা পুলিশ-প্রশাসনের হ্যাপা সামলানোয় কোনও কোনও দাদার নামটাই যথেষ্ট।

পুজো ময়দানে ‘দাদাগিরি’ অবশ্য নতুন নয়। ডানপন্থী রাজনীতির দাদারা বহু দিন ধরেই শহরের পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কখনও দাদাদের নামেই পুজোর পরিচিতি হয়। যেমন, কলেজ স্কোয়্যারের পুজোর সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে রয়েছেন কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র। তিনি সক্রিয় ভাবে না থাকলেও ওই পুজো কমিটির লোকেরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারের পুজো কার্যত প্রদীপ ঘোষের (একদা কংগ্রেস নেতা, এখন বিজেপিতে) পুজো বলেই লোকে চেনে। একডালিয়ার পুজোর গোড়া থেকেই সেখানে জড়িয়ে রয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আবার তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসুর নামডাক হয়েছিল শ্রীভূমির পুজো থেকেই।

Advertisement

ক্লাব সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তরতরিয়ে পুজো ময়দানের তারকা হয়ে উঠেছে নাকতলার উদয়ন সঙ্ঘ। এখন তো ওই পুজোকে শিক্ষামন্ত্রীর পুজো বলেই লোকে চেনে।

আবাসনমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই নিউ আলিপুর সুরুচির পরিচয় অরূপ বিশ্বাসের পুজো বলে। লোকে বলে, পুর-রাজনীতিতে অরূপের উত্থানের পরেই সুরুচির জৌলুস বেড়েছিল। এখন তো অরূপবাবুর নাম দেখা যায় আরও কয়েকটা পুজোয়। সেগুলি অরূপ বিশ্বাসের পুজো হয়ে না উঠলেও মন্ত্রীর নামের মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত, এমনটাও নয়। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই চেতলা অগ্রণীর পুজোয় জড়িয়ে। তবে বন্দর এলাকার বহু পুজোতেও নাম দেখা যায় স্থানীয় বিধায়ক ফিরহাদের।

মন্ত্রী না হলেও মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষেরও পুজো বাজারে চাহিদা প্রবল। এক সময়ে হাতিবাগানের একটি ক্লাবই অতীন ঘোষের পুজো বলে পরিচিত ছিল। লোকে বলে, ধীরে ধীরে রাজনীতিতে যত উঠেছেন অতীনবাবু, ততই তাঁর ছাতার তলা বেছে নিয়েছে ক্লাবগুলো। এখন হাতিবাগানের প্রায় সব পুজোতেই জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর নাম। মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারের নাম ত্রিধারা সম্মিলনীর সঙ্গে দেশপ্রিয় পার্কের পুজোতেও জুড়ে রয়েছে।

শুধু ক্লাব নয়, শিল্পীরাও ইদানীং দাদার আশ্রয়ে থাকতে চাইছেন। পুজো ময়দানের প্রথম সারির এক শিল্পী হাতিবাগানের একটি ক্লাবের ঘরের ছেলে বলেই পরিচিত ছিলেন। বছর দুয়েক আগে এক পুর-নেতার পুজোয় কাজ করেন তিনি। এ বার অবশ্য দাপুটে মন্ত্রীর পুজোয় কাজ করছেন তিনি। আর এক শিল্পী গত তিন বছরে নেতা-মন্ত্রীর পুজোর বাইরে কাজই করেননি। দাদা ধরায় উৎসাহী কেন পুজোকর্তারা?

দক্ষিণ কলকাতার এক পুজোকর্তার বক্তব্য, স্পনসরের টাকা আসার আগেই অনেক কাজ শুরু করে দিতে হয়। বাকির খাতায় প্লাইউড, পাইপ পেতে পাড়ার কাউন্সিলর হোক বা রাজ্যের মন্ত্রীর ফোন সাহায্য করে। স্পনসর পেতেও ‘দাদা’ই ভরসা। তাই বিজ্ঞাপনের বাজার হাতাতেই বেশি দাদার ব্যবহারে মেতে উঠেছেন পুজোকর্তারা। উত্তর কলকাতার এক পুজোকর্তার কথায়, “দাদা যদি দরাজ মন আর দাপুটে মেজাজের হন, তা হলে তো কথাই নেই।’’

এই উক্তির যথার্থতা মিলবে ভবানীপুর-কামারহাটি, মায় দমদমেও। ভবানীপুর-কামারহাটির বেশির ভাগ ক্লাবের ব্যানারেই মিলবে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের নাম। বরাহনগরের অলিগলির পুজোতেও তিনি উদ্বোধন করেছেন, এমন নজিরও রয়েছে। যদিও মদনবাবুর বক্তব্য, ভবানীপুরের একটি ক্লাবই তাঁর নিজের।

দমদম স্টেশন থেকে নাগেরবাজার যাওয়ার পথে দু’পাশে যত দুর্গাপুজোর ফেস্টুন-ফ্লেক্স নজরে আসবে, সবেতেই রয়েছে চেয়ারম্যান পারিষদ প্রবীর পাল ওরফে কেটির নাম। “নিজের নিজের এলাকায় দু’জনেই তো দাপুটে নেতা বলে খ্যাত।”মন্তব্য উত্তর শহরতলির এক পুজো কমিটির কর্মকর্তার।

তবে পুজোর এই দাদাচিত্রে ব্যতিক্রমও আছে। এই শহরেরই কোনও কোনও পুজো আছে, যারা দিদিতেই খুশি। সেই সব ক্লাবের আবদারে প্রতি বছর স্যুভেনিরের প্রচ্ছদ আঁকেন খোদ দাদাদের ‘দিদি’-ই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন