চিনেরা জানেন না, চায়না আসলে ‘চাই না’

স্টুডিয়োয় কাজের ফাঁকেই চলছিল সে সব গল্প। গত ১৩ থেকে ২০ জুন কুনমিংয়ে, চিন আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার সেই প্রদর্শনীতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৮ ০৭:৪০
Share:

শিল্পী: প্রতিমায় তুলির টানে ব্যস্ত চায়না পাল। নিজস্ব চিত্র

চায়নায় চায়না!

Advertisement

কুমোরটুলির মেয়ে যে তাঁদের দেশের সমনামী, তা জেনে এ ভাবেই আহ্লাদ প্রকাশ করেছিল চিনের দূতাবাস।

সম্প্রতি একটি প্রদর্শনীতে অংশ নিতে চিন সফরে গিয়েছিলেন পটুয়া পাড়ার মৃৎশিল্পী চায়না পাল। সেখান থেকে ফিরে গল্প-আড্ডায় এমনই নানা অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন।

Advertisement

তিন মেয়ের পরে ফের আর এক মেয়ে হওয়ায় বাবা হেমন্তকুমার পাল তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘চাই না’। সেটাই পরে বদলে হয়েছে চায়না। বহু বছর পরে সেই নাম যে এমন আনন্দ দেবে ওই মেয়ের একগুচ্ছ ভিন‌্‌ দেশি বন্ধুকে, তা আর কে জানত! যদিও সেই নামের কারণ জানতে পারেননি চিনা দূতাবাস কিংবা প্রদর্শনীর আয়োজকেরা। নিজেদের দেশের নামে ভারতের মেয়ের নাম জেনে তাঁরা খুবই খুশি হয়েছিলেন বলেই দাবি চায়নার।

কুনমিংয়ে পাঁচ দিনের প্রদর্শনীতে সেখানকার লোকজনকে মাটির মুখ ও আঙুল বানানো শিখিয়ে এসেছেন কুমোরটুলির মেয়ে চায়না। এক ভাগ বেলে মাটির সঙ্গে দু’ভাগ এঁটেল মাটি মিশিয়ে বানাতে হয় মুখ। আবার এঁটেল মাটিতে পাট কুঁচো মিশিয়ে তৈরি করতে হয় আঙুল। দেখে এসেছেন শিল্পচর্চার নানা ধরনও। প্রদর্শনীতে গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাহেবের নাচ এবং মেমসাহেবের ছবি আঁকা দেখে মুগ্ধ চায়না বলেছেন, ‘‘এমন ভাবেও ছবি আঁকা যায়!’’

স্টুডিয়োয় কাজের ফাঁকেই চলছিল সে সব গল্প। গত ১৩ থেকে ২০ জুন কুনমিংয়ে, চিন আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার সেই প্রদর্শনীতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। সে দেশের ভাষা না বুঝলেও মৃৎশিল্পে ভারতের প্রতিনিধি, কুমোরটুলির ১ নম্বর বনমালী সরকার স্ট্রিটের চায়না দোভাষির মাধ্যমে জেনেছেন, তাঁর তৈরি প্রতিমার তারিফ করেছেন ‘চিনে ম্যানেরা’। ২৪ বছর ধরে একচালার প্রতিমা গড়া চায়নার ঝুলিতে এখন কত যে গল্প সে দেশের!

গত এপ্রিল মাসের দুপুরে আচমকাই অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন এসেছিল। তখনই ভাঙা হিন্দিতে এক ব্যক্তি চায়নাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চিনে যাওয়ার। রাজি হতেই দেওয়া হয়েছিল কয়েকটি শর্ত। খড়ের কাঠামো ছাড়া পুরো মাটির দুর্গা বানাতে হবে। চায়না বলেন, ‘‘এক চালচিত্রের মধ্যে সপরিবার দুর্গা বানিয়ে ব্যাগে করে নিয়ে গেলাম। ওই দেশে গিয়ে মুখ বানালাম।’’ শুধু দুর্গা নয়, কালী-সহ আরও কয়েকটি মূর্তি বানিয়ে ব্যাগে ভরে নিয়েছিলেন চায়না। সঙ্গে অবশ্যই নিয়েছিলেন মাটি। বলছিলেন, ‘‘কখনও বিদেশে যাইনি, তাই প্রস্তাবটা আসতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।’’ জানালেন, সে দেশের লেকের পাশে বিলাসবহুল হোটেলে বসে রোজ ভেবে নিতেন পরদিন নতুন কী বানানো যায়। কী করে আরও সুন্দর কাজ করা যায়!

মেয়ে এই ব্যবসায় আসুক, তা অবশ্য কখনওই চাননি শিল্পী হেমন্তবাবু। কিন্তু ১৯৯৪ সালে দুর্গাপুজোর দেড় মাস আগে মৃত্যু হয় বাবার। সেই প্রথম কাজের ভার নেন চায়না। তখন থেকেই শুরু পটুয়া পাড়ায় তাঁর পথ চলা। বনমালী সরকার স্ট্রিট, বাগবাজার মিলিয়ে চায়নার এখন তিনটি স্টুডিয়ো। সেখানেই তৈরি হয় একচালার দুর্গা থেকে, কালী, গণেশ, সরস্বতী, লক্ষ্মীর প্রতিমা। ছোটবেলায় খাতায় পেনসিল দিয়ে প্রতিমার চোখ আঁকতে ভালবাসতেন খুব। এখন আর নিজে টুলে উঠে বড় সাইজের দুর্গা প্রতিমার বাঁশপাতা (বিশেষ ধরনের টানা আকারের চোখ) চোখ আঁকার সাহস পান না। তবে চিনের সংগ্রহশালায় স্থান পাওয়া দেড় ফুটের এক চালার দুর্গার বাঁশপাতা চোখ এঁকেছেন তিনি নিজেই।

তাঁরই একটি স্টুডিয়োয় বসে জমে উঠেছিল চিন সফরের গল্প। ‘দিদি’র এমন সব অভিনব অভিজ্ঞতা শুনে কৌতূহল বেড়েছিল তাবু নামের বছর পঁচিশের এক কর্মীর। কথার
সঙ্গে চলছিল কাজও। ‘‘খড়টা শক্ত করে বাঁধবি। সুতলি দড়িগুলো বেশ লম্বা! ’’— তাবুকে এমন সব নির্দেশ দিতে দিতেই হঠাৎ হেসে ফেললেন দিদি। পর ক্ষণেই বললেন, ‘‘গোল টেবিলটা ঘুরে যখন আমার সামনে এল, দেখলাম খড় বাঁধার দড়ির থেকেও বড় চাউমিন। লম্বা কাঠি দিয়ে খেতে হবে। আমি অবশ্যি খাইনি।’’

আবাক চোখে শুনছিলেন ওই কারিগর। তাবু জানতে চাইলেন, ‘‘তা হলে ওখানে খেলে কী?’’

হেসে বললেন, ‘‘কেন? গলদা চিংড়ি, কাতলাও ছিল তো!’’ তাবুও নিশ্চিন্ত, বিদেশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেও নিজের সংস্কৃতি দাপটে ধরে রেখেছেন তাঁর দিদি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন