১৯৭৪ সালে বিয়ের পর থেকেই এ পাড়ার মোহিনীমোহন রোডে মল্লিকবাড়িতে রয়েছি। তা প্রায় ৪২ বছর তো হয়েই গেল। তবে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে পড়েছিলাম ১৯৬৯ সালের শেষ দিকেই। বাবা বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের অধিকর্তা হিসেবে কলকাতায় আসার সূত্রেই আমাদেরও এখানে আসা। সেই থেকে কলকাতায় থাকা। কলেজের মাঝপথে এখানে এসে ভর্তি হলাম রানি বিড়লা কলেজে। তখন তা ছিল মডার্ন হাইস্কুলের চার তলায়। তখন আমরা থাকি সেলিমপুর এলাকায় গড়িয়াহাট রোড, সাউথে। জীবনের আঠেরোটা বছর কাটিয়ে আসা শান্তিনিকেতনের সেই খোলামেলা পরিবেশ ছেড়ে এখানে আসাটা ছিল বিশাল একটা ধাক্কা। যাকে বলে ‘কালচারাল শক’! প্রথম এক-দেড় মাস খুব কান্না পেত। এখানকার মানুষজনের চলাফেরা, কথাবলা— সবই তো ছিল একেবারে অন্য রকম। তবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মানিয়ে নিয়েছিলাম। তার বছর চারেক পরেই বিয়ে করে চলে এলাম ভবানীপুরে।
তবে সেলিমপুরের ওই পাড়া বাঙালি এলাকা হলেও আমাদের এই পাড়াটা একটু অন্য রকম। এখানে বাঙালিরা ছিলেন, তবে পঞ্জাবি সর্দারজিদের ভিড় ছিল বেশি। তাই রাস্তায় বেরোলেই দোকানগুলিতে মিলত রুটি-তরকা, সরসো কা শাগ ইত্যাদি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গাধীঁর মৃত্যুর পর থেকে পঞ্জাবিদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। এখন অবশ্য বাঙালিদের ভিড়ও অনেক কমে গিয়েছে। বেড়েছে গুজরাতি পরিবারের সংখ্যা। পাশে রায় স্ট্রিটকে তো মিনি আমদাবাদ বললেও ভুল বলা হবে না। গুজরাতিদের মন্দির-স্কুল-হাসপাতাল রয়েছে সেখানে। গুজরাতি খাবারের দোকান তো ভরা এই এলাকায়। রয়েছেন জৈনরাও। তবে এঁদের পাশে আমাদের মল্লিকবাড়ির পাশাপাশি লাহা-মিত্তিরদের বনেদি পরিবারগুলি এখনও টিকে রয়েছে।
যদুবাবুর বাজার থেকে এলগিন রোড পর্যন্ত এই পাড়ায় কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের বাস। এই যেমন যদুবাবুর বাজারে (অনেকে আবার জগুবাজারও বলে থাকেন) মেলে সব রকম জিনিসপত্র। রোজ দু’বেলা যত সংখ্যক ও যত রকম গাড়ি এসে দাঁড়ায়, তাতেই বোঝা যায় কত রকম লোকের বাস এ পাড়ায়। লোকজন এখানে যেমন রোজের বাজার করতে আসেন, তেমনই বিদেশি এমন অনেক জিনিসপত্র পাওয়া যায় যে ভিন্দেশি লোকজনও এখানে আসেন কেনাকাটা করতে। এখানে কিন্তু শহরের একটি বিশাল ও ভাল ফলের বাজার রয়েছে। আর পাঁচ-সাত মিনিট হেঁটে গেলেই এলগিন রোডে ফোরাম-আইনক্স, বড় বড় কাফের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ব্র্যন্ডের জামাকাপড়ের দোকানও।
তবে যতই ঝাঁচকচকে হোক না কেন, আমাদের পাড়ার স্নিগ্ধতা কিন্তু আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছে। যার একমাত্র কারণ, গাছ অনেক কমে যাওয়া। নর্দান পার্কই এখানে সবচেয়ে বড় খোলামেলা জায়গা। এলগিন রোডে অবশ্য কিছু বাগানওয়ালা বাড়ি রয়েছে। তবে বাদবাকি অংশ একেবারেই সবুজ-সতেজ নয়, বরং পাড়াটা ভরে গিয়েছে লোহা-লক্কড়ে। তার একটা বড় কারণ, আমাদের বাড়ির পিছন দিকেই উড়িয়া পাড়া। গাড়ির মেকানিকদের এলাকা। সব সময় ঠুক-ঠাক ঠুং-ঠাং আওয়াজ। গাড়ি সংক্রান্ত দোকান ও কারিগরেরা এখানে বেশি থাকায় গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। ফলে পার্কিংটা এখানে বিশাল সমস্যা। রাস্তার যেখানে-সেখানে গাড়ি রেখে দেন লোকজন। মোহিনীমোহন রোড বিশাল বড় না হলেও বেশ ছোট কিন্তু নয়। তাতেও ঢুকতে-বেরোতে বেশ সমস্যা হয়। আগে কিন্তু এই সমস্যা এতটা ছিল না। অবশ্য এখন তো কলকাতা শহরে গাড়ির সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। তাই হয়তো এই সমস্যাও বেড়েছে। অন্যান্য পাড়াতেও হয়তো একই অবস্থা।
আমাদের পাড়ায় ফুটপাথও কিন্তু বিশেষ চোখে পড়ে না। বেশির ভাগই দোকানগুলির দখলে। এই পার্কিং ও ফুটপাথের সমস্যায় হাঁটতে হয় রাস্তার উপর দিয়েই। তবে রাস্তায় যা সবচেয়ে খারাপ লাগে, তা হল পড়ে থাকা নোংরা, ভ্যাটের উপচে পড়া জঞ্জাল। অভ্যেস মতো আমরা এ দোষও অন্যের কাঁধেই চাপাই। এ জন্য কিন্তু আমরা নিজেরাই দায়ী বলে মনে করি।
পাড়ায় গাছগাছালি বেশি না থাকায় যেমন খারাপ লাগে, তেমনই পাড়া জুড়ে দোকানের ভিড় দেখতেও চোখের বিশেষ আরাম হয় না। তা সে হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান হোক বা মোটর পার্টস, বা এটিএম, কোনও দর্জির দোকান বা বিউটি পার্লার। হাতের কাছে সব কিছু পাওয়া যায় বলে আমাদের অবশ্য খুব সুবিধেই হয়। কিন্তু দু’তিনটি বাড়ি পর পর দোকান পাড়াটাকে ছিমছাম রাখার জন্য ঠিক নয় বলেই আমার মনে হয়।
তবে যা-ই হোক, আমাদের পাড়াটি কিন্তু বেশ শান্তিপূর্ণ। মোড়ের মাথায় আইসক্রিম পার্লারে ছেলেরা সব ভিড় করে আড্ডা দেয় ঠিকই, কিন্তু কোনও দিন কোনও গোলমাল হয়নি। এখনকার ছেলেমেয়েরা অবশ্য যা-ই করুক না কেন, নিজেদের মধ্যেই করে। পাড়ায়কে কোনও রকম ভাবে বিরক্ত করে না। রাজনৈতিক কোনও গণ্ডগোলও এখানে কোনও দিন দেখিনি। ভোটের সময়ে মিটিং-মিছিল যা হয়, ওই পর্যন্তই। এমনকী চুরি-ডাকাতিও হয় বেশ কম। এত কম, যে একবার হলে তা মানুষের মনে বেশ দাগ কেটে যায়। এই যেমন কয়েক বছর আগে আমারই বাড়িতে ঢোকার মুখে এক ছাত্রীর গলার হার ছিনতাই হয়েছিল। এই এত বছরে এ রকমই দু’একটি ঘটনা ছাড়া আর কিন্তু আমি শুনিনি।
বৃষ্টিতে খানিক সমস্যা হয় বটে, তবে আমাদের পাড়ায় কিন্তু আগের তুলনায় অনেক কম জল জমে। আমাদের মোহিনীমোহন রোডকে অবশ্য বৃষ্টির সময়ে পাড়ার মধ্যে একটি দ্বীপ বলেই মনে হয়। আশাপাশে রাজেন্দ্র রোড, অ্যালেনবি রোডে জল জমলেও আমাদের বাড়ির সামনে জল খুব তাড়াতাড়ি নেমে যায়। লোডশেডিংও এখানে একেবারেই হয় না।
এ তো গেল রোজকার কথা। যে কোনও উৎসব বা পুজো এ পাড়ায় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়। এখানে বেশ বড় বড় দুর্গাপুজোও হয়। আমি অবশ্য পুজোয় বাড়িতেই থাকি। আমাদের বাড়িটাই তখন একটা পাড়ার আকার নেয়। আগে যখন সবাই একসঙ্গে থাকতেন, তখন ঠিক এমনই মনে হত। এখন নানা কারণে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছেন। তবে মল্লিকবাড়ি যে একান্নবর্তী পরিবার, তা বেশ বোঝা যায় পুজোর সময়ে। ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় এ সব দিক থেকে এ বাড়ি আমার কাছে একটু অন্য রকমই ছিল। তবে নিজের বিশ্বাস বজায় রেখেও আমি এ পরিবারেরই একজন। আগে এই পুজো অনেক বেশি আমাদের ছিল। এখন যেন তা সকলের হয়ে উঠেছে। পুজোর সময়ে বাঁশ বেঁধে ভিড় আটকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। আমাদের বাড়িটি দেখলে কিন্তু এখনও সেই সাবেক ছোঁয়াটা পাওয়া যায়। যত দিন সম্ভব তা-ই ধরে রাখব। পাড়ায় কিন্তু সাবেক বাঙালি বাড়ি এখন আর বিশেষ দেখাই যায় না। তবে এই সব বাড়ির দেখভালের নানা রকম সমস্যা থাকাতেই হয়তো বেশির ভাগ লোকজনই বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভাল-মন্দ মিলিয়ে মিশিয়ে যেমনই হোক, এ পাড়া এখন আমারই। আগে কলকাতা মানে ছিল ছুটিতে বেড়াতে আসা বা বিশ্বভারতীর কোনও অনুষ্ঠানে আসা। এখন তো কাজকর্ম, পরিবার— সবই এখানে। শান্তিনিকেতনে আমাদের পুরনো বাড়ি রয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন বরং ওই বাড়িই আমাদের ছুটি কাটানোর, বেড়াতে যাওয়ার ঠিকানা।
লেখক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী