ম্যাটাডর থেকে শব্দবাজি, প্রতিবাদে জুটল বেধড়ক মার

নিয়ম ভাঙাটাই যেন নিয়ম আর প্রতিবাদ করাটাই যেন অপরাধ। এটাই এখন চেনা ছবি হয়ে গিয়েছে শহরের!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৫৩
Share:

শুভজিৎ গড়াই

নিয়ম ভাঙাটাই যেন নিয়ম আর প্রতিবাদ করাটাই যেন অপরাধ। এটাই এখন চেনা ছবি হয়ে গিয়েছে শহরের!

Advertisement

শব্দবাজি বা মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করা হলে হয় বাড়ির জানলার কাচ ভেঙে দেওয়া হবে, নয়তো জুটবে মার। কালীপুজোর দিন থেকে শুরু হয়েছে একের পর এক এমনই ঘটনা, মঙ্গলবার রাতেও যার সাক্ষী থাকল শহরের রাজপথ।

ওই রাতে ফুলবাগান থানা এলাকার কাদাপাড়ায় একটি সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন চার তরুণ-তরুণী। তখন কালী প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের জন্য যাচ্ছিল একটি ম্যাটাডর। অভিযোগ, তাতে সওয়ার যুবকেরা রাস্তায় নির্বিচারে শব্দবাজি ছুড়ে ছুড়ে ফাটাচ্ছিল। সেই বাজি ওই চার জনের মধ্যে এক তরুণীর সামনে এসে পড়ায় আপত্তি জানান তাঁর এক বন্ধু।

Advertisement

অভিযোগ, সেই সময়ে ঘটনাস্থলের প্রায় ১০০ মিটার দূরের কিয়স্কে থাকা পুলিশের সাহায্য চান ওই তরুণ-তরুণীরা। কিন্তু পুলিশ এগিয়ে আসেনি। বরং পুলিশের সামনেই ম্যাটাডর থেকে নেমে জনা পঁচিশেক যুবক ওই প্রতিবাদী তরুণকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে বাকি তিন জনও বেধড়ক মার খান। এই ঘটনায় পুলিশ আক্রান্ত তরুণের অভিযোগও ঠিক ভাবে গ্রহণ করতে চায়নি বলেও অভিযোগ। বুধবার রাতে অবশ্য সেই ম্যাটাডরটি আটক করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনায় জখম দুই তরণের নাম শুভজিৎ গড়াই (২২) ও আকাশ দত্ত (২৪)। তাঁদের বাড়ি উত্তর কলকাতার হালসিবাগান এলাকায়। মঙ্গলবার রাতে ওই ঘটনার পরে তাঁদের স্থানীয় নার্সিংহোমে চিকিৎসা করানো হয়। সঙ্গে থাকা অন্য দুই তরুণীও অল্পবিস্তর আহত হয়েছেন।

শুভজিৎ জানিয়েছেন, থানায় তিনি যখন লিখিত অভিযোগ করতে যান, তখন সেই অভিযোগে ওই ম্যাটাডরের নম্বর উল্লেখ না করার পরামর্শ দেয় পুলিশ। এমনকী, অভিযুক্ত হামলাকারীরা যে ক্লাবের সদস্য, সেই ক্লাবের নামও অভিযোগে উল্লেখ করতে বারণ
করা হয়।

এ প্রসঙ্গে বুধবার লালবাজারে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার শুধু বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। এর বেশি কিছু এখনই বলা যাবে না।’’

এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বুধবার চার জন যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত চার জনের নাম শান্তনু প্রসাদ, সোমনাথ মাইতি, অজয় মল্লিক এবং সোমনাথ বেরা।

যে ক্লাবের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই কাদাপাড়া বালকবৃন্দ ক্লাবের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পাল। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিধায়ক হওয়ার সুবাদে আমি স্থানীয় অনেক ক্লাবেরই পৃষ্ঠপোষক। যা ঘটেছে, তা ঠিক হয়নি। অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত।’’

শুভজিৎ জানান, তাঁর মাথার দু’দিকেই আঘাত লাগে। বাঁ চোখের নীচেও কালশিটে পড়ে গিয়েছে। শুভজিতের বান্ধবী এ দিন বলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাতের ওই ঘটনা শহরে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার এক উদাহরণ। কয়েক জন অসহায় তরুণ-তরুণী রাস্তায় আক্রান্ত। পুলিশ কোনও সাহায্যই করল না। এ দিন তো আরও বড় বিপদ হতে পারত।’’

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘‘কাদাপাড়ার একটি ক্লাব প্রতি বারই কালীপুজোর বিসর্জনের সময়ে এখানে তাণ্ডব চালায়। মঙ্গলবার রাতের ঘটনাও অনেকটা সে রকমই।’’ ওই ক্লাবের সদস্য স্বপন দে বলেন, ‘‘চকলেট বোমা ছোড়া নিয়েই গোলমাল। যারা প্রতিমা ভাসানোর জন্য গিয়েছিলেন,
তাঁরা ঠিক কাজ করেননি। এই ঘটনায় যে কোনও লোকই প্রতিবাদ জানাতে পারেন।’’

শুভজিৎ জানান, তিনি তাঁর বোন, এক বন্ধু এবং বান্ধবীকে নিয়ে ওই রাতে কাদাপাড়ার কাছে মাল্টিপ্লেক্সে বিকেলের শো-এ সিনেমা দেখতে যান। সাড়ে আটটায় সিনেমা শেষ হওয়ার পরে তাঁরা চার জনই মাল্টিপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে নারকেলডাঙা মেন রোডে ফুলবাগানের অটো ধরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন।

শুভজিৎ জানান, বান্ধবীর পায়ের সামনে বোমা ফাটার পরে সাহায্য চাইতে তিনি পুলিশের কিয়স্কে যান। তখন এক জন পুলিশকর্মী এগিয়ে এসে ম্যাটাডরে থাকা যুবকদের থামতে বলেন। কিন্তু তারা থামেনি। উল্টে জানতে চায়, কে তাদের নামে নালিশ করেছে? সেই পুলিশকর্মী তখন শুভজিৎকে দেখিয়ে বলেন, ‘উনি অভিযোগ করেছেন।’ শুভজিতের কথায়, ‘‘এর পরে কয়েক জন যুবক ম্যাটাডর থেকে নেমে আমায় প্রথমে ঘুষি এবং পরে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারতে শুরু করে। ওই পুলিশকর্মী আমাকে ট্র্যাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তখন এক জন ট্র্যাফিক সার্জেন্ট ঘটনাস্থলে এসে আমাকে মার খেতে দেখে ফোর্স চেয়ে পাঠান। কিন্তু আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।’’

অভিযোগ, শুভজিৎকে মার খেতে দেখে তাঁর বোন এগিয়ে এলে তাঁর চুলের মুঠি ধরে হাত মুচড়ে দেয় এক যুবক। শুভজিতের বন্ধু আকাশ প্রতিবাদ করলে তাঁকে রাস্তার পাশে একটি গুমটিঘরে ঢুকিয়ে মারা হয়। শুভজিতের বান্ধবীকেও ওরা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। বেশির ভাগ যুবকই ঘটনার সময়ে মত্ত অবস্থায় ছিল বলে অভিযোগ।

শুভজিৎ এ দিন জানান, ঘটনার পরে কোনও রকমে ওই যুবকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে ম্যাটাডরের নম্বরটা নেন তাঁরা। ট্যাক্সি করে শুভজিৎ থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এর মাঝেই ঘটনাস্থল থেকে ম্যাটাডর নিয়ে চম্পট দেয় ওই যুবকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন