ডেপুটি হাই কমিশনে ভিড়। — দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বৃহস্পতিবার থেকে নয়াদিল্লি যখন বাংলাদেশিদের অতি সহজে ভিসা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করছে, বাংলাদেশি ভিসা পেতে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ তখন দিনভর কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের কাউন্টারে কাউন্টারে ঘুরে চূড়ান্ত হেনস্থা হচ্ছেন।
ভিসা পাওয়া তো দূরের কথা, নতুন অনলাইন পদ্ধতির চক্করে পড়ে আবেদনই জমা দিতে পারছেন না মানুষ। আর তা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি, এমনকী কান্নাকাটিও। ডেপুটি হাই কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, অসুবিধা হচ্ছে জেনেও তাঁদের কিছু করার নেই। কারণ এটা ঢাকার বিদেশ দফতরের সিদ্ধান্ত, গত শুক্রবার থেকে অনলাইনেই ভিসার আবেদন জমা দিতে হবে। অন্যথায় কাউকে ভিসা দেওয়া যাবে না।
এ দিকে কারও বাবা মারা গিয়েছেন বলে এখনই চট্টগ্রাম দৌড়তে হবে, কারও বা চাকরি রাখতে ঢাকা ফেরার তাড়া। সবের জন্যই এক্ষুণি ভিসা পাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু উপস্থিত সবারই অভিযোগ, ভিসার আবেদনের জন্য যে ওয়েবসাইটটির কথা বলা হয়েছে, ঠিকমতো কাজই করছে না সেটা। আধখানা ফর্ম পূরণের পরে সব ঘেঁটে যাচ্ছে। কারও বা ছবিই আপলোড হচ্ছে না। অনেক বার চেষ্টায় যদিও বা ছবির সমস্যা মিটল, তত ক্ষণে পূরণ করা বাকি তথ্য গিয়েছে মুছে। সব মিলিয়ে ফর্ম পূরণ করতেই নাজেহাল মানুষ। অথচ, তার প্রিন্ট আউট সঙ্গে নিয়ে না-এলে ভিসাই মিলবে না!
বেকবাগানে বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনে গিয়ে দেখা গেল, কী ভাবে আবেদনপত্র জমা হবে— বেশির ভাগ মানুষের কাছেই তা স্পষ্ট নয়। অথচ নতুন ব্যবস্থা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের তরফে কেউ নেই। কাউন্টার থেকে জবাব মিলছে, ‘‘আমরাই জানি না, তো আপনাদের কী জবাব দেব!’’
বছর চল্লিশের জীবন দাস জানালেন, বাবা হঠাৎ মারা গিয়েছেন। এখনই চট্টগ্রাম যেতে হবে। হাজার চেষ্টা করেও অনলাইনে আবেদনপত্র ভরতে পারেননি। রবিবার রাতে মালদহ থেকে ছুটে এসে লাইন দিয়েছিলেন তিনি। রাতভর লাইনে দাঁড়িয়েও সমস্যা মেটেনি। কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে, আবার চেষ্টা করুন। ‘‘আবার চেষ্টা করেও যে কাজ হবে, তার নিশ্চয়তা কী?’’— হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন যুবক।
লাইনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষক সুব্রত মজুমদার। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন তিনি। জানান, শুক্রবার থেকে চেষ্টা করেও ভিসা পুনর্নবীকরণের আবেদনটাই এখনও জমা দিতে পারেননি।
এক বিদেশিনীও সামান্য তথ্য জানতে এসে বিপদে পড়লেন এ দিন। অনলাইনে আবেদনপত্র ভরতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন ওই তরুণীও। কিন্তু বিদেশি নাগরিকদের জন্য নির্ধারিত কাউন্টারের ভিড় প্রবীণদের। ফলে কাউন্টারে যেতে গেলে বাধা দেওয়া হয় তাঁকে। অনেক চেষ্টায় কাউন্টারে পৌঁছেও সমস্যা মেটেনি। কী ভাবে ভিসার টাকা জমা দেবেন, তা জানতে চাইলে উত্তর আসে, ‘‘ঠিক জানা নাই!’’ এই জবাব দিয়েই কাউন্টার ছেড়ে উঠে যান ওই কর্মী। জনরোষ গিয়ে পড়ে তরুণীর উপরে। এত ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই তাঁর জামা ধরে টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেন।
আবেদনপত্র ভরতে ভিড় জমতে থাকে ডেপুটি হাইকমিশনের কাছের সাইবার কাফেতেও। একটা সময়ে দেখা যায়, ভিসার লাইনে যত লোক, প্রায় ততটাই ভিড় জমেছে ওই সাইবার কাফের লাইনেও। কেউ কেউ আবার কাজ খানিকটা সহজ করতে শরণাপন্ন হন ল্যাপটপ হাতে ঘুরে বেড়ানো দালালদের। কিন্তু তারাও অন্ধকারে। টাকা নিয়েও সাহায্য করতে না-পারায় দালালদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে
পড়েন অনেকে।
ডেপুটি হাই কমিশন সূত্রের বক্তব্য— যে কোনও নতুন জিনিস শুরু হলে প্রথমে কিছু অসুবিধে হয়। অচিরেই তা কেটে যাবে বলে তাঁরা আশাবাদী। উপ দূতাবাসের এক কর্তার বক্তব্য, অনলাইনে আবেদন জমা দিতে সকলেরই যে সমস্যা হচ্ছে, এমন নয়। শুক্রবার প্রথম দিনে ১১৩টি আবেদন জমা পড়েছিল, সোমবারও জমা হয়েছে ২০২টি। এক অফিসারের কথায়, মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে জেনেও কিছু করার নেই। কারণ, এটা ঢাকার বিদেশ দফতরের সিদ্ধান্ত। উপ-দূতাবাস সূত্রের খবর, নতুন পদ্ধতিতে ঠিকঠাক আবেদন করার পরেও ভিসা পেতে অন্তত ১৫ দিন সময় লাগবে। কারণ অনলাইনে আবেদন জমা পড়ার পরে অনুমোদন প্রক্রিয়ার অনেকটাই এখন ঢাকায় হবে। আগে কলকাতার হাতে ভিসা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল।