নিয়ম ভেঙে এ ভাবেই গাড়ির যাতায়াত। মঙ্গলবার। — শৌভিক দে
অকেজো ট্রাফিক সিগন্যাল, নজরদারির অভাব, চালকদের নিয়ম না-মানার প্রবণতা আর রাস্তা জুড়ে পার্কিং। সব মিলিয়ে মৃত্যুফাঁদ তৈরিই ছিল। সেই ফাঁদে পড়ে সল্টলেকে এর আগেও একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেছে। হুঁশ ফেরেনি গাড়িচালক ও পথচারীদের। মঙ্গলবার সকালে সেই মৃত্যুফাঁদ কেড়ে নিল দু’টি প্রাণ।
বেপরোয়া এই যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ বার তাই বেছে নেওয়া হচ্ছে কড়া দাওয়াই। এই প্রথম সল্টলেকের ভিতরে কোনও দুর্ঘটনায় চালকের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় (অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানো) মামলা রুজু করল পুলিশ। এর আগে মাস দুয়েকের মধ্যে রাজারহাটে দু’টি দুর্ঘটনায় দুই লরিচালকের বিরুদ্ধে ওই একই ধারায় মামলা করেছে পুলিশ। যার ফলে, ওই লরিচালক দু’জন এখন জেলে রয়েছেন।
বিধাননগরের এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘এত দিন এই ধরনের দুর্ঘটনার পরে বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং গাফিলতির মামলা করা হচ্ছিল। গ্রেফতার হওয়ার পরে চালক পরের দিন আদালত থেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছিলেন। কয়েক দিন পরে তাঁকে আবার স্বমহিমায় দেখা যাচ্ছিল।’’ অথচ ৩০৪ ধারায় মামলা হলে কড়া শাস্তি হবে এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা কমে যাবে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্তারা। সল্টলেকে গাড়ির গতি কমাতে গাড়ি ধরে ধরে ‘কেস’ দেওয়াও শুরু করেছে পুলিশ।
এই বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মূল অভিযোগ উঠেছে বাস ও অটোচালকদের বিরুদ্ধেই। মঙ্গলবার সকালে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, শুধু সল্টলেকের সিটি সেন্টারের সামনের সেই মোড় নয়, সাজানো উপনগরীর এমন বহু চারমাথার মোড়েরই এখন এমন অবস্থা। গোটা সল্টলেক জুড়েই চলছে গাড়িচালকদের নিয়ম ভাঙার খেলা। সিএ আইল্যান্ড, করুণাময়ী-সহ কয়েকটি মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের সক্রিয়তা নজরে আসে। কিন্তু, পিএনবি, ৪, ১০ ও ১৩ নম্বর ট্যাঙ্ক, বিকাশ ভবনের মোড়ের মতো বহু জায়গা রয়ে গিয়েছে নজরদারির বাইরে। বহু মোড়ে, আইল্যান্ডে ট্র্যাফিক সিগন্যাল নেই। আবার অনেক মোড়ে সিগন্যাল থাকলেও সেখানে হলুদ আলোই জ্বলতে নিভতে থাকে। ফলে, অনেক সময়ে গাড়িচালকেরাও
বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। যখন তখন গাড়ির সামনে চলে আসে সাইকেল রিকশাও। কার্যত গোটা সল্টলেক জুড়েই বেপরোয়া যান চলাচল।
মঙ্গলবার যেখানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেই মোড়টি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। এক দিকে সিটি সেন্টার, অন্য দিকে অফিসপাড়া —প্রতিদিন কয়েক লক্ষ মানুষ যাতায়াত করেন ওই মোড় দিয়ে। ওই এলাকায় প্রচুর গাড়ি পার্ক করা হয়। পর্যাপ্ত পার্কিং-এর জায়গা না থাকায় রাস্তার দু’ধারে, এমনকী রাস্তার মাঝে বুলেভার্ডের পাশেও পার্কিং-এর ব্যবস্থা। এর ফলে গাড়ি চলাচলের রাস্তা গিয়েছে কমে। ওই রাস্তার উপরেই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ চলছে।
সূত্রের খবর, এই মোড়েই গত দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সিগন্যাল ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। কোনও পুলিশ কর্মী সেই সিগন্যাল চালাতে গেলে একসঙ্গে সবুজ-লাল-হলুদ আলো জ্বলে যাচ্ছিল। কিন্তু, সেটি না চালালে সারা দিন ধরে হলুদ আলো জ্বলা-নেভা করছিল। এ দিন দুর্ঘটনার সময়ে প্রতিটি কোনায় হলুদ আলো জ্বলছিল-নিভছিল। ফলে, যে যার মতো খুশি গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকালে ওই মোড়ে যে সিভিক পুলিশদের থাকার কথা ছিল, তাঁদের কেউ সেখানে ছিলেনও না। অফিস-টাইমে অন্য মোড়ে বেশি দরকার বলে তাঁদের সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের কথায়, ঘটনার সময়ে মাত্র দু’জন সিভিক পুলিশকে ওই মোড়ে দেখা গিয়েছে। সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করার বুথে কেউ ছিলেন না। দু’জন মোড়ের দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ কেন, তা নিয়ে সদুত্তর দিতে পারেনি বিধাননগর পুলিশ। তবে এ দিন দুর্ঘটনার পরে দেখা যায়, সিগন্যাল মেরামতির কাজ চলছে। বিধাননগর ট্র্যাফিক পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘সিগন্যাল ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
দুর্ঘটনার পরে স্থানীয় ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তুলসী সিংহ রায় ঘটনাস্থলে গিয়ে সিভিক পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। গাড়ির চাপ প্রতিদিন বাড়ছে এই মোড়ে। তাই পুলিশের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বাসিন্দাদের পাল্টা অভিযোগ, ওই মোড়ে কোনও নির্দিষ্ট বাসস্টপও নেই। যাত্রীরা যত্রতত্র অপেক্ষা করেন, বাস এবং অটোচালকেরাও তেমন ভাবেই গাড়ি থামান। পার্কিং-এর জেরে রাস্তায় হাঁটাচলার অবস্থা নেই।
মেয়র সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘‘পুলিশের সঙ্গে কথা বলেই পার্কিং-এর জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়।’’