গয়নার জৌলুসে জমে উঠেছে ভিড় টানার লড়াই

বনেদি বাড়ির সেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া এখন দেখা যায় শহর ও শহরতলির বিভিন্ন পুজোয়। বারোয়ারি পুজোও নিজের আভিজাত্য জাহির করতে মজেছে গয়নায়। কেউ সোনার গয়নায় মূর্তি সাজাচ্ছেন।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৯
Share:

দেবী স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা!

Advertisement

পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনীর সেই রূপের উল্লেখ রয়েছে। আর সেই সূত্র ধরেই এক সময়ে বাংলার জমিদারেরা সমাজে নিজেদের আভিজাত্য জাহির করতে মৃন্ময়ী দুর্গামূর্তির গা ভরিয়ে তুলতেন সোনার গয়নায়। হাতের অস্ত্রও তৈরি হত রুপো দিয়ে।

বনেদি বাড়ির সেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া এখন দেখা যায় শহর ও শহরতলির বিভিন্ন পুজোয়। বারোয়ারি পুজোও নিজের আভিজাত্য জাহির করতে মজেছে গয়নায়। কেউ সোনার গয়নায় মূর্তি সাজাচ্ছেন। কেউ আবার মণ্ডপই তৈরি করছেন রুপো দিয়ে। আর তাঁদের এই জাঁকজমকের নেশায় মজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে শহরেরই কিছু গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থা। পুজোর শেষে ওই গয়না ফেরত চলে যায় তাদের কাছে। কিছু পুজোয় আবার ‘মানত’ করে প্রতি বছর গয়না দেন সাধারণ মানুষও।

Advertisement

অনেক ক্ষেত্রেই শুধু এই গয়নার জন্য বারোয়ারি পুজো ঘিরে দর্শনার্থীদের মধ্যে কৌতূহল ও উন্মাদনা তৈরি হয়। যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশ প্রশাসনকে। বেশ কয়েক বছর ধরে শহরের কিছু পুজোর নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে গয়নার কথা। যেমন, লেক টাউনের শ্রীভূমি স্পোর্টিং, বৌবাজারের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার বা ম্যাডক্স স্কোয়ার। এ বছর অবশ্য সেই তালিকায় রীতিমতো ঢাক বাজিয়ে নাম লিখিয়েছে উত্তর কলকাতার আহিরীটোলা সর্বজনীন এবং বরাহনগরের নেতাজি কলোনি লো ল্যান্ড সর্বজনীন।

সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের সভাপতি প্রদীপ ঘোষের দাবি, তাঁরা কখনওই কাউকে নকল করেন না। বরং ১৫ বছর আগে তাঁরাই প্রথম হিরের গয়নায় সাজিয়েছিলেন প্রতিমা। সেই বছর অবশ্য একডালিয়া এভারগ্রিনের প্রতিমাও সেজেছিল হিরের অলঙ্কারে। গত বছরও সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোয় সোনার শাড়ি পরানো হয়েছিল প্রতিমাকে। এ বার সেখানেই ছয় টন রুপো দিয়ে তৈরি হচ্ছে রথ। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘মানুষ নতুনত্ব চায়, তাই এমন চমক। আর অধিকাংশ পুজোরই এখন মূল উদ্যোক্তা কোনও না কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাই পুজোটাও এখন ক্ষমতা ও সামর্থ্য জাহিরের ঠান্ডা স্নায়ুর লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।’’

যদিও কোনও লড়াইয়ের কথা মানতে নারাজ শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোক্তারা। তাঁরা জানান, চার বছর আগেও ওই পুজোর ঝাড়বাতি দেখতে ভিড় জমত। সেখানেই স্বাদবদল করতে চার বছর আগে প্রথম ২০ কেজি সোনার গয়নায় সাজানো হয়েছিল গোটা প্রতিমা। তার পর থেকে অবশ্য সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। হিরের দ্যুতিও ছড়িয়েছে ওই মণ্ডপে। এ বার পদ্মাবত সিনেমার সেটের আদলে তৈরি মণ্ডপে প্রতিমার গায়ে থাকছে কয়েক কেজি সোনার গয়না।

কারও সঙ্গে লড়াই নয়, সাধারণ মানুষের দেওয়া গয়নাতেই প্রতি বছর তাঁদের প্রতিমা সাজানো হয় বলে জানান ম্যাডক্স স্কোয়ারের সুবীর মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘১৯৬০ সালে প্রথম মা দুর্গাকে সোনার মুকুট পরানো হয়। তার পরে একে একে সবাইকেই গয়না পরানো শুরু হয়। তবে সব গয়নাই কেউ না কেউ নিজে থেকে দিয়েছেন। প্রতি বছরই মানত করে অনেকে নতুন গয়না দেন।’’

৭৯ বছরে এই প্রথম আহিরীটোলা সর্বজনীনের পুজোয় প্রতিমার মুকুট থেকে পায়ের তোড়া— সবই সোনার। কয়েক দিন আগে এক পাঁচতারা হোটেলে সেই গয়নার প্রদর্শনীও হয়েছে। পুজোর যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল শীলের কথায়, ‘‘দর্শক বাড়ানো বা কারও সঙ্গে লড়াই করা লক্ষ্য নয়। পুজোর শেষে আমরা এবং যে সংস্থা গয়না দিয়েছে, তারা মিলে নিলাম করব। যা টাকা আসবে, তা নারী শিক্ষায় ব্যবহার করা হবে।’’

বরাহনগরের নেতাজি কলোনি লো-ল্যান্ডের পুজোয় প্রতিমাকে সাজানো হচ্ছে রানি ভিক্টোরিয়ার ব্যবহার করা গয়নার আদলে তৈরি অলঙ্কার দিয়ে। ৬০ কেজি সোনার অলঙ্কারের সাজে বাদ যাবে না অসুরও। বেনারসিতে থাকবে জরির কারুকাজ। তবে লড়াইয়ের কথা মানতে নারাজ পুজোর মুখ্য সংগঠক তথা চেয়ারম্যান পারিষদ দিলীপনারায়ণ বসু। তিনি বলেন, ‘‘উত্তর শহরতলিতে আমরাই প্রথম গয়না পরাচ্ছি ঠিকই। মানুষকে আকৃষ্ট করতেই এই পরিকল্পনা। এতে লড়াই কীসের?’’

লড়াইয়ের কথা উদ্যোক্তারা সরাসরি না মানলেও পুজোর ক’দিন এই গয়না জাহিরের চক্করে জমিদারের লেঠেল বাহিনীর মতো ঘাম ঝরবে পুলিশ-প্রশাসনের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন