রবীন্দ্র সরোবরে পরিযায়ী পাখির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

প্রতি বছরের মতো এ বারও শীতের শুরুতে থেকেই পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলতে শুরু করেছে সাদার্ন অ্যাভিনিউ এবং রবীন্দ্র সরোবর চত্বরে। প্রায় প্রতিদিনই পাখির ছবি তুলতে যাওয়া একটি গ্রুপের সদস্যেরা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই সরোবরের লায়ন্স সাফারি পার্কে তাঁরা ৯৩টি ভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:০২
Share:

সমস্যা: নির্মাণকাজের জন্য ইট-সুরকি ফেলে সাফ করা হচ্ছে জঙ্গল। রবীন্দ্র সরোবর চত্বরে। ছবি: সুমন বল্লভ

কয়েক হাতের মধ্যেই গাছের ডালে বসে ফেরুজিনাস ফ্লাইক্যাচার। পাহাড়ি এই পাখিটিকে লেন্সবন্দি করতে সাবধানে এগোচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। মাটিতে প্রায় শুয়ে পড়ে, নিঃশব্দে ঝোপের আড়াল থেকে ক্যামেরা তাক করে রয়েছেন, এই সময় হঠাৎ বিকট আওয়াজ! একযোগে কয়েক জন বলে উঠলেন, ‘খিয়া’। চিত্রগ্রাহক চমকে উঠে দেখলেন, পাখি ততক্ষণে ফুরুৎ!

Advertisement

পাশেই চলছে ক্যারাটের প্রশিক্ষণ। সেখান থেকেই এ হেন আওয়াজে বিরক্ত চিত্রগ্রাহক বললেন, ‘‘দিন-রাত এত আওয়াজ! এখানেই মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে। এখানেই ক্যারাটে শেখানো হচ্ছে! সেই সঙ্গে সবই কংক্রিটের করে দেওয়ার হুজুগ! সরোবরের লায়ন্স সাফারি পার্কে আবার সিটিজেন্স পার্ক তৈরি হচ্ছে! পাখিরা থাকবে কী করে?’’ আর এক চিত্রগ্রাহকের এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া, ‘‘হাতের কাছেই এই ধরনের পাখির দেখা মিলছে। বুঝতে হবে, এখনও সবটা শেষ হয়ে যায়নি। তবে এ ভাবে সবই মানুষের ব্যবহারের জন্য করে দিলে পাখি আর আসবে না।’’

প্রতি বছরের মতো এ বারও শীতের শুরুতে থেকেই পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলতে শুরু করেছে সাদার্ন অ্যাভিনিউ এবং রবীন্দ্র সরোবর চত্বরে। প্রায় প্রতিদিনই পাখির ছবি তুলতে যাওয়া একটি গ্রুপের সদস্যেরা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই সরোবরের লায়ন্স সাফারি পার্কে তাঁরা ৯৩টি ভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন। জয়দীপ দাস নামে এক চিত্রগ্রাহকের কথায়, ‘‘রাস্টি টেলড ফ্লাইক্যাচার, ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার, ব্লু-ক্যাপড রক থ্রাশ, ব্ল্যাক নেপড মনার্কের মতো পাখির ছবি তুলেছি আমরা। শুক্রবারই বেঙ্গালুরু থেকে এক চিত্রগ্রাহক এসেছিলেন ক্রো-বিল্‌ড ড্রঙ্গোর ছবি তুলতে। রবীন্দ্র সরোবরে এসে তিনি ওই ছবি পেয়েছেন।’’ জয়দীপবাবুর দাবি, ‘‘রবীন্দ্র সরোবরের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তবু যদি পাখির থাকার উপযুক্ত জায়গা রাখতে না পারি, তাহলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা।’’

Advertisement

রবীন্দ্র সরোবরে পাখির ছবি তুলতে যাওয়া বেশ কিছু গ্রুপের সদস্যদের দাবি, পাখি থাকার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা নিয়ে সরোবর কর্তৃপক্ষের সে ভাবে কোনও হেলদোল নেই। অভিযোগ, অবাধে জঙ্গল সাফ করে কংক্রিটের রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। সেই সঙ্গে যত্রতত্র রয়েছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আলো। যার জেরে সমস্যায় পড়ছে পরিযায়ীরা। অভীক রায় নামের এক চিত্রগ্রাহক বলেন, ‘‘সরোবরের লায়ন্স সাফারি পার্কের মধ্যে আগে তিনটি জায়গায় মূলত পাখির দেখা মিলত। তারই একটিতে এখন সিটিজেন্স পার্ক তৈরি হচ্ছে। ইট-সুরকি ফেলে জঙ্গল সাফ করে দেওয়া হয়েছে।’’

পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত আবার জানাচ্ছেন, পরিযায়ী পাখিরাই শুধু নয়, সারা বছর ধরে রবীন্দ্র সরোবর চত্বরের গাছে বসবাস করা পাখিদের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাঁর কথায়, ‘‘পাখির স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে, সেই সঙ্গে চড়া আলো পাখিদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। পাখিদের জীবনযাপনের ধরনই বদলে যাচ্ছে। ফল হচ্ছে মারাত্মক।’’ সুভাষবাবুর মতে, এই চড়া আলো এবং দিনরাত ধরে চলতে থাকা আওয়াজ পুলিশি ‘থার্ড ডিগ্রি’র মতো। পাখিদের ঘুমোতে দিচ্ছে না। বললেন, ‘‘আলোর ব্যবহারে আরও সতর্ক থাকতে হবে। সরোবরের জলের দূষণ নিয়েও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে। তা ছাড়া একের পর এক পার্ক তৈরিতেও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।’’

লায়ন্স সাফারি পার্কের সদস্য মোহন আগরওয়ালের অবশ্য দাবি, ‘‘পার্কের মাত্র একটি জায়গাতেই এখন সিটিজেন্স পার্ক তৈরি করছি। বাকিটা আগের মতোই থাকছে। পাখিদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা পরিবেশ ধ্বংস করে কিছু করার পক্ষে নই।’’ কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র (কেএমডিএ) তরফে রবীন্দ্র সরোবরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পরিবেশরক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন, সবটাই করা হয়। পাখির বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ নষ্ট করার প্রশ্নই ওঠে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement