‘‘আমাদের ছোটবেলায় পুজোর মাঠে বায়োস্কোপ বাক্স আসতো।’’
‘‘বায়োস্কোপ কী দাদু? তাতে ম্যাজিক হয়?’’
গ্রামের লাল মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আশি বছরের রাঘবেন্দ্রবাবুকে প্রশ্ন করল কলকাতাবাসী নাতি সাগ্নিক।
মুচকি হেসে দাদু বললেন, ‘‘ও সব এখন গল্প।’’
কথা বলতে বলতে দু’জনে গিয়ে বসলেন দুর্গা মন্দিরের চাতালে। ক’দিন পরেই পুজো। সামনের মাঠের এক কোণে তৈরি হচ্ছে মঞ্চ, সেখানেই নাকি পুজোর তিন দিন কলকাতার আর্টিস্ট নিয়ে এসে নাচ-গানের অনুষ্ঠান হবে। স্থানীয় এক যুবকের থেকে কথাটা শুনে একটু মুষড়ে পড়লেন রাঘবেন্দ্রবাবু। ছলছলে চোখে বললেন, আমাদের সময়ে পুজোয় দিনুকাকুরা মাথায় করে নিয়ে আসতেন বায়স্কোপের বাক্স। তাতে চোখ লাগিয়ে দেখতাম কালীঘাটের কালী, তাজমহল, কুতুবমিনার আরও কত কী...। পুজোর ক’দিন আগে থেকে সাদা পর্দা টাঙিয়ে নির্বাক-সবাক সিনেমাও দেখত গোটা পাড়া।
অবাক চোখে দাদুর দিকে তাকিয়ে সাগ্নিক বলল “তাই নাকি। আমাদের কলকাতার বাড়ির কাছে ব্রহ্মপুর অগ্রদূত ক্লাবের পূজোয় এ বছর তো রঙিন বায়োস্কোপ বাক্স আর বিভিন্ন সিনেমা নিয়েই মণ্ডপ সাজছে।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। নাতির হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলেন দাদু। কিছুটা এগোতেই দেখলেন ক্লাবের মাঠে থিম পুজোর প্রস্তুতি চলছে। রাঘবেন্দ্রবাবু বললেন, ‘‘সাবেক পুজো বোধহয় উঠেই গেল! এখন সবই থিম।’’
দাদুর হাত ছেড়ে সাগ্নিক বলল ‘‘দাদু তুমি কিচ্ছু জানো না। সাবেকিয়ানা ও থিম-বাংলার শারদোৎসবের মেলবন্ধনে এ বার মণ্ডপ সাজাচ্ছে পূর্ব কলকাতা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। ওখানে নতুন-পুরনো দিনদু’য়েরই মেজাজ মিলবে। প্রবেশদ্বার থেকে মূল মন্দির প্রতিমা সবেতেই থাকবেই সাবেকিয়ানা আর থিমের ছোঁয়া।” সাগ্নিক আরও বলল “শুধু কি তাই! আমার বন্ধু শ্রেয়াদের পাড়া চেতলা সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন ও পাপুদের পাড়া এন্টালির কাঁঠালবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির পুজোও সাবেক।”
বাড়ির পথে দাদু-নাতির সঙ্গে দেখা হল যদু গোয়ালার। দুধের ব্যবসা তুলে এখন তিনি স্টেশনে ভ্যান রিকশা চালান। যদুর সঙ্গে কথা বলে এগোলেন দু’জনে। হাঁটতে হাঁটতে নাতিকে বললেন, ‘‘দাদুভাই কোনও মানুষই ছোট নয়। মা দুগ্গা আছেন সকলের মধ্যে।’’ শুনেই সাগ্নিকের মনে পড়ে গেল গ্রামের বাড়িতে আসার সময়েই বাবা বলেছিল পুজোয় সমরকাকুদের পাড়ায় নিয়ে যাবে। সেখানে অজয়নগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব সোসাইটির মণ্ডপে থাকবে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার। আর গোয়ালিনীর রূপে থাকবেন মা দুর্গা।”
বাড়ি ফিরে আরাম কেদারায় বসলেন রাঘবেন্দ্রবাবু। গ্রামাফোনে বাজছে ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’। হঠাৎ সাগ্নিকের প্রশ্ন, ‘‘দাদু, কবিগুরুর বাড়িতে পুজো হত?’’ রাঘবেন্দ্রবাবু বললেন, ‘‘হতো বইকি। সিমলার বাড়িতে বড় পুজো হত।’’ শুনেই সাগ্নিক হাততালি দিয়ে বলল, “স্কুলে যাওয়ার সময়ে হোর্ডিংয়ে দেখেছি, রবি ঠাকুরের সেই বাড়িই বানাচ্ছে হাজরা ২২পল্লি সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি।”
খুশিমনে রাঘবেন্দ্রবাবু নাতিকে বললেন, ‘‘দাদুভাই পুজোর পরে যে কন্যাকুমারী যাব, তোমার জন্য কী আনবো। শুনেই সাগ্নিকের দাবি, “অত দূর যাবে কেন? আমার সঙ্গে কলকাতা চলো। নিউ আলিপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির মণ্ডপ এ বার হচ্ছে বিবেকানন্দ রকের আদলে। কৃষ্ণনগরের প্রতিমাও থাকবে।”
আঁধার পেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। কলকাতায় ফিরবে সাগ্নিকেরা। মন ভাল নেই রাঘবেন্দ্রবাবুর। আনমনে আলমারি খুলে বের করলেন কাচের তৈরি একটি গাছ। সাগ্নিকের হাতে উপহারটি দিয়ে বললেন, “কাচের জিনিস যত্নে রাখলে যেমন শোভা বৃদ্ধি করে তেমনি প্রকৃতিকে যত্নে রাখলে তা মানুষেরও উপকার করে, এটা ভুলো না দাদুভাই।” অবাক হয়ে সাগ্নিক জিজ্ঞাসা করল, ‘‘তাই কি আমাদের স্কুলের পাশে কালীঘাট মিলন সঙ্ঘের মণ্ডপ কাচ দিয়ে তৈরি গাছের আদলে হচ্ছে?’’
এ বার সাগ্নিকদের বেরোনোর পালা। প্রণাম করতেই সাগ্নিকের মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে দাদু বললেন, “মনে রেখো, প্রতিটি মানুষেরই জীবনে নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে। আর তা নিজেই করা উচিত। দেবদেবীরাও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়।” মুখের কথা শেষ না হতেই সাগ্নিকের মা বলে উঠলেন, “আরে এই
ভাবনা নিয়েই তো এ বার নন্দরাম সেন স্ট্রিট সর্বজনীন দুর্গোৎসবের মণ্ডপ সেজে উঠছে।”
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সাগ্নিকেরা ফিরে চলল কলকাতা। পলেস্তারা ওঠা পুরনো বাড়ির দরজা আগলে একাই দাঁড়িয়ে রইলেন রাঘবেন্দ্রবাবু। ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে উঠলেন ‘জয় মা দুগ্গা।’