পূর্ত দফতরের অবহেলা হলেও পূর্তমন্ত্রীকে দায়ী করলেন না মমতা!

‘‘পূর্ত দফতরেরও দায়িত্ব ছিল। আমাদের দফতর হলেও ক্ষমা করব না। কারণ, অবহেলা নজরে এসেছে। যে কাজ দ্রুত করা উচিত ছিল, তা ফাইল চালাচালি করতে গিয়ে অযথা দেরি হয়েছে। আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। সে সব কিছুই করা হয়নি।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:২১
Share:

ছবি: পিটিআই।

মাঝেরহাট সেতু ভাঙার দায় এত দিন মেট্রো রেলের ঘাড়ে চাপিয়ে আসছিল রাজ্য সরকার। এমনকি, ঘটনার ঠিক পরে পূর্ত দফতরের দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে তেমনই ইঙ্গিত ছিল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও মেট্রোর কাজের জন্য তৈরি কম্পনকে সেতু ভাঙার পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যসচিবের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট বলল, সেতুভঙ্গের দায় পূর্ত দফতর এড়াতে পারে না।

Advertisement

মলয় দে-র পেশ করা সেই রিপোর্টকে ভিত্তি করে শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পূর্ত দফতরেরও দায়িত্ব ছিল। আমাদের দফতর হলেও ক্ষমা করব না। কারণ, অবহেলা নজরে এসেছে। যে কাজ দ্রুত করা উচিত ছিল, তা ফাইল চালাচালি করতে গিয়ে অযথা দেরি হয়েছে। আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। সে সব কিছুই করা হয়নি।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। যাঁরা দোষী, কেউ রেহাই পাবেন না। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সব ফাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

তবে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে কোনও ভাবেই দায়ী করতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ওই ঘটনার সঙ্গে পূর্তমন্ত্রীর কোনও যোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ফাইল তাঁর কাছে কখনও পৌঁছয়নি।’’ ২০১৬ সাল থেকে পূর্ত দফতরের দায়িত্ব অরূপের কাঁধে। কেন তাঁর কাছে মাঝেরহাট সেতুর সংস্কার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পৌঁছবে না, কেন মন্ত্রী হিসেবে সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল না-থাকা তাঁর ‘ব্যর্থতা’ বলে গণ্য হবে না, সে সব প্রশ্নের কোনও উত্তর নবান্নের ১৪ তলা থেকে মেলেনি। অরূপও এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, পূর্ত দফতরে ১০ কোটি টাকার কম মূল্যের কোনও কাজের ফাইল মন্ত্রীর কাছে যায় না। মাঝেরহাট সেতুর অবস্থা যে এত ভয়াবহ, সে কথাও মন্ত্রীর কানে কোনও দিন পৌঁছয়নি।

Advertisement

আরও পড়ুন: নয়া সেতু গড়ার সিদ্ধান্ত ঘিরে প্রশ্ন

যা শুনে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সাত দিন লাগল পূর্ত দফতরের দোষ ধরতে? আর পূর্তমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে পূর্ত দফতর কী ভাবে হয়! এখন সমালোচনার মুখে নিচু তলার কর্মীদের উপর দোষ চাপাচ্ছেন!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন পূর্তমন্ত্রীকে বাঁচাতে। তাই উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। আমরা বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই।’’ বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাহুল সিংহের প্রতিক্রিয়া, ‘‘মন্ত্রীর কাছে ফাইল আসে না, কর্মীরা গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় মন্ত্রীকে জানান না, সে আবার কী! এমন অযোগ্য মন্ত্রীর নিজেরই তো পদত্যাগ করা উচিত।’’

মুখ্যমন্ত্রী জানান, মুখ্যসচিবের রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ২০১৬ সালে যখন সেতুর তথ্য জানা গিয়েছিল, তখনই কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি, বিকল্প পথ বের করে ‘দুর্বল’ সেতুর উপর যানবাহনের ভার কমানোর ব্যবস্থা কেন করা হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

দফতরের যাঁদের ‘গাফিলতি’ রয়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। তদন্তে দোষীদের পুলিশ বা মুখ্যসচিবের কমিটি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকতে পারে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

কী সেই গাফিলতি? পূর্ত দফতরের অন্দরের খবর, ২০১৬ সালে খড়গপুর আইআইটি-কে মাঝেরহাট সেতু সংস্কারের জন্য উপদেষ্টা সংস্থা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তারা জানিয়েছিল, সেতুর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে ঝুঁকি এড়াতে সেতুতে বড় গাড়ি নিষিদ্ধ করা, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং বছরের পর বছর পিচ-কংক্রিট ঢালায় যে ‘ডেড লোড’ বেড়েছে, তা কমানো দরকার। পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের জন্য প্রায় তিন কোটি টাকা চেয়ে পূর্ত এবং অর্থ দফতরের মধ্যে দীর্ঘদিন ফাইল চালাচালি হয়। পূর্ত দফতরের অভিযোগ, অর্থ দফতর সেই কাজের অনুমোদন দেয়নি।

অন্য দিকে অর্থ দফতরের বক্তব্য, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ, ‘ডেড লোড’ কমানো, ভারী গাড়ি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি কাজে যে খরচ হত, তা দফতরের পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকেই খরচ করা যেত। অর্থ দফতরের আগাম অনুমোদন লাগত না। প্রাথমিক ঝুঁকি না-ঠেকিয়ে পূর্ত দফতর সেতুটিকে ওই অবস্থায় ফেলে রাখার ফলেই এই বিপর্যয় বলে মনে করছে অর্থ দফতর। মুখ্যসচিবের রিপোর্টে সামগ্রিক ভাবে পরিস্থিতির বিচার করে পূর্ত দফতরের ঘাড়েই দায় ফেলা হয়েছে।

এরই পাশাপাশি মুখ্যসচিবের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, মেট্রো প্রকল্পের থেকে তৈরি কম্পনের একটা প্রভাব সেতু-বিপর্যয়ের উপর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা খতিয়ে দেখতে আরও সময় প্রয়োজন। কারণ, কারিগরি দিক থেকে তা নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘এত অল্প সময়ের মধ্যে অত বড় কারিগরি বিষয় বোঝা সম্ভব নয়। ফের তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মাসখানেকের মধ্যে চূড়ান্ত রিপোর্ট হবে।’’

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তদন্তের প্রয়োজনেই প্রাথমিক রিপোর্ট না-আসা পর্যন্ত মেট্রো রেলকে কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। এখন তাদের কাজ শুরু করতে কোনও বাধা নেই। যার উত্তরে মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কলকাতা পুলিশ চিঠি দিয়ে তাঁদের কাজ বন্ধ রাখতে বলেছিল। তারা ফের চিঠি দিয়ে কাজ শুরু করতে বললে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement