ঢাকে কাঠি

‘সবাইকে ভাল রেখো মা’

৮৭ বছর পরেও রমা, অর্থাৎ রমাপদ পালের স্মৃতিতে সেরা পুজো সেটাই। গল্পের সঙ্গী পেয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্টের এক বৃদ্ধাশ্রমের বিছানা ছেড়ে নিজেই উঠে বসলেন বছর সাতানব্বইয়ের চিকিৎসক।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪৭
Share:

আড্ডা: একটি বৃদ্ধাবাসে অবসর যাপনে আবাসিকেরা। নিজস্ব চিত্র

চার কাঁধে রাখা বাঁশের মাঝে প্রতিমা নিয়ে হনহনিয়ে ভাগীরথীর দিকে ছুটছেন চার যুবক। অনুগামী গ্রামের বড়রাও। এ দিকে আলপথ আর কাশবন পেরিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটছে ছোট্ট রমা আর তার সঙ্গীরা। সকলের আগে ওদের পৌঁছনোর তাড়া। ভাগীরথীর তীর জমজমাট। একটি নৌকা প্রতিমা নিয়ে ভ্রমণের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। তৈরি আরও ৬০টি। গ্রামের বাড়িগুলি থেকে তোশক, চাদর আর তাকিয়া চেয়ে নিয়ে এসেছেন মাঝিরা। সবাই নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়েও দিয়েছেন। কারণ, পাড়ার জামাইরা যে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাইচ প্রতিযোগিতায় শামিল হবেন! কোনও নৌকায় গ্রামোফোনে বাজছে পুজোর গান, কোথাও বাজছে বিউগল, কোথাও সানাই। এটাই নিয়ম মুর্শিদাবাদের জিৎপুর গ্রামের।

Advertisement

৮৭ বছর পরেও রমা, অর্থাৎ রমাপদ পালের স্মৃতিতে সেরা পুজো সেটাই। গল্পের সঙ্গী পেয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্টের এক বৃদ্ধাশ্রমের বিছানা ছেড়ে নিজেই উঠে বসলেন বছর সাতানব্বইয়ের চিকিৎসক। স্মৃতি এখনও বিশ্বস্ত সঙ্গী তাঁর। পুজোর আর কোনও স্মৃতি? দীর্ঘ বছর অরুণাচল, নাগাল্যান্ড আর মিজোরাম বর্ডারে চাকরি সূত্রে ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে দুর্গাপুজো মানে স্থানীয় আদিবাসী নৃত্য, সাহেবদের নাচ আর রঙিন জলের উৎসব। বিপত্নীক মানুষটি এ বার ঘরে বসে টিভিতে পুজো পরিক্রমা সারবেন।

তবে নব্বই বছরের অচলা কর্মকার গত বছর বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন ঠাকুর দেখতে। এ বারও বেরোবেন বেহুলা হালদার, সাবিত্রী সাহা, গীতা মিত্রদের সঙ্গে। যদিও বার্ধক্যের থাবায় কাবু বেশির ভাগ আবাসিক পুজো টিভিতেই দেখবেন বলে সেটির আলো-রিমোট সংক্রান্ত টুকটাক কাজ চলছে তখন। সংস্থার তরফে সঞ্জয় শূর বলেন, “সবারই নানা সমস্যা। তাই পুজোয় ভাল খাওয়ানোয় জোর দেওয়া হয়। ইচ্ছুকদের ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাব। কোল্ড ড্রিঙ্ক, আইসক্রিমও খাবেন।”

Advertisement

ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের কাছেই বিভিন্ন ভাষাভাষির বৃদ্ধ মানুষদের যে ঠিকানা, সেখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত বেশির ভাগ আবাসিক ধরে রেখেছেন সেই আমেজটাই। ওঁরা পুজোর সকালে ঠাকুর দেখতে যাবেন। পুজোর কেনাকাটায় বেরিয়েছিলেন দু’দিন। পুজোর দিন বিশেষ পদের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানালেন বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার বিজয় নস্কর। এখানকারই এক আবাসিক, শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা, ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী অশীতিপর শ্যামলী সেনের কাছে পুজো মানে আরও আরও রবীন্দ্রনাথ। “তাঁর বই পড়া আর গান শোনাতেই খুঁজে পাই আমার প্রাণের রবীন্দ্রনাথকে। তিনিই আমার দেবতা। উপরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করার তালিকাটাও তো দীর্ঘ হচ্ছে!”— হাসতে হাসতে বলে উঠলেন শ্যামলীদেবী।

চাহিদার তালিকাটা সত্যিই আপেক্ষিক। দু’বেলা খেতে দেওয়ার চাহিদা মেটাতেই স্থানীয় কয়েক জন আশ্রয়হীনকে নিয়ে আমতলায় বছর কয়েক ধরে একটি বৃদ্ধাবাস চালাচ্ছেন ব্যবসায়ী চন্দন পাল। ওঁদের দেখাশোনা করাটা কোনও কৃতিত্ব নয়, কর্তব্য, মনে করেন তিনি। এই পুজোয় বন্ধুরা মিলে ৩৪ জন বৃদ্ধাকে নতুন শাড়ি দিয়েছেন। আশপাশের ঠাকুর দেখা আর ভাল ভাল খাবারে ওঁরা পুজোর আনন্দ খুঁজে পান।

দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, প্রতিষ্ঠিত ছেলে যে দিন স্থির করলেন, বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করবেন, সে দিনই ঠিক করেন, মাকে উত্তর কলকাতার এক বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবেন। কারণ, পুজোর বাড়িতে অসুস্থ মায়ের অসুবিধা হবে। কথা দিয়েছিলেন, পুজো মিটলে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কথা রাখেননি একমাত্র ছেলে। তবে নিয়মিত মায়ের জন্য টাকা পাঠান। বছর তিরিশ আগে নির্মলাদেবীর (নাম পরিবর্তিত) কাছে দুর্গাপুজো ছিল উৎসব। সাত বছর ধরে পুজো আসতেই তাই বাজতে থাকে বিসর্জনের সুর। তিনি বলে চলেন, “সবাই এখন ব্যস্ত। আমরাও ছিলাম। তখন পুজোয় কত কেনাকাটা করেছি, ঘরদোর পরিষ্কার করেছি, মিষ্টান্ন করতাম, অতিথি আপ্যায়ন করতাম। এখন ক্লান্ত, তাই বিশ্রাম দরকার।” শূন্য দৃষ্টিতে কপালে দু’হাত ঠেকিয়ে বলে ওঠেন― ‘‘ওরা ভাল থাকুক, সবাইকে ভাল রেখো মা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন