অতীতের ধুলো ঝেড়ে এখনও জারি ঐশ্বর্যের খোঁজ

বিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতা সত্যিই কল্লোলিনী। সবে শেষ হয়েছে ব্রিটিশ শাসন। দেশ ছেড়ে যাওয়া অনেকেই নিলামের জন্য দিয়ে যেতেন বাড়ির নানা জিনিস। রুচিশীল ক্রেতাদের আগ্রহে জমে ওঠে পুরনো আসবাব ও অন্য শিল্পসামগ্রীর বেচাকেনা।

Advertisement

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:০৩
Share:

যতনে: নিলামঘরের অন্দরে। —নিজস্ব চিত্র।

‘‘আজ তো সবার চোখ ঘড়িটার উপরেই।’’

Advertisement

শীতের রবিবাসরীয় দুপুরে বড় হলঘরের মতো দোকানটায় জনা পঞ্চাশের একটা ভিড় থেকে ভেসে এল মন্তব্যটা। চারদিক ঠাসা দেশি-বিদেশি বিচিত্র জিনিসে। বর্মা সেগুনের দেরাজের উপরে হাতির দাঁতের কাজ করা ভাঙা তানপুরা, পাশে আধুনিক ওয়াশিং মেশিন-ল্যাপটপ। ইউরোপীয় পোর্সেলিনের পুতুলের সঙ্গে নিশ্চিন্ত সহাবস্থান জাপানি নক্সার স্যুপ বোলের। বাহারি ঝাড়লণ্ঠন, হলদে হয়ে আসা পাথরের মূর্তি, ব্রিটিশ ডিনার সেট, গ্রামোফোনের ঝকঝকে চোঙ— কী নেই নোনা ধরা ওই চার দেওয়ালের মধ্যে! তার মধ্যেই রসিকদের নজর আটকে বিশেষ একটি ঘড়ির উপরে।

পার্ক স্ট্রিটের অদূরে ৭৫ পার করে ফেলা নিলামঘরে যখন হাতুড়ি শেষ বারের মতো নেমে এল, তখন ওই ঘড়ির দাম পৌঁছেছে তিরিশ হাজারে। পরে প্রবীণ অকশনিয়ার আরশাদ সালিম বলছিলেন, তেমন তেমন জিনিস আর জহুরী ক্রেতা পেলে এই ধরনের ঘড়ির দাম পৌঁছতে পারে লাখের কাছাকাছি।

Advertisement

বিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতা সত্যিই কল্লোলিনী। সবে শেষ হয়েছে ব্রিটিশ শাসন। দেশ ছেড়ে যাওয়া অনেকেই নিলামের জন্য দিয়ে যেতেন বাড়ির নানা জিনিস। রুচিশীল ক্রেতাদের আগ্রহে জমে ওঠে পুরনো আসবাব ও অন্য শিল্পসামগ্রীর বেচাকেনা। বিত্তশালী বাঙালি ছাড়াও ভিড় জমাতেন অন্য দেশের কূটনীতিক, ভিন্‌রাজ্যের সমঝদারেরা। পরে শহরের অর্থনীতি দুর্বল হতে শুরু করায় একে একে ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয়েছে শহরের গোটা বিশেক নিলামঘরের বেশির ভাগই।

রাসেল এক্সচেঞ্জ এখন এ শহরের তো বটেই, দেশের মধ্যেও টিকে থাকা নিলামঘরের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বলে পরিচিত। বর্তমান মালিক আনোয়ার এবং আরশাদ সালিমের ঠাকুরদার হাত ধরে চলা শুরু হয়েছিল ১৯৪০-এ। এখন অবশ্য আগের মতো শুধু আসবাব বা শিল্পসামগ্রীনয়,নিলামের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে হাতল ভাঙা বৈদ্যুতিন কেটলি থেকে শিশুর বহু ব্যবহৃত জুতোজোড়াও। আরশাদ বললেন, ‘‘চারটে দেওয়াল ছাড়া নিলামঘরে সব কিছুই বিক্রির জন্য। সব জিনিসেরই ক্রেতা রয়েছে।’ নিলামে ওঠা জিনিসের মতোই ক্রেতাদের বৈচিত্রও দেখার মতো। কেউ বহু দিনের ক্রেতা, কেউ এসেছেন কম দামে সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর খোঁজে, কেউ আবার এখান থেকে জিনিস কিনে অন্যত্র ফের বেচবেন। ১৮ বছর বয়সে নিলামের হাতুড়ি হাতে তোলা আরশাদ আত্মবিশ্বাসী, আলপিন থেকে এরোপ্লেন সবই বিক্রি করে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর।

টিকে থাকার লড়াইয়ে পরির্বতন এসেছে ব্যবসার ধরনেও। নিলামে উপযুক্ত দাম মিলবে না, এমন কিছু জিনিসের নির্দিষ্ট দাম ধার্য করে রেখেছেন তাঁরা। রেস্ত থাকলে কিনতে পারেন কোনও গুণগ্রাহী। পুরনো আসবাব শ্যুটিংয়ের জন্য ভাড়াও দেওয়া হয়। এই পথ নিয়েছে পাশে থাকা সুমন এক্সচেঞ্জ আর মডার্ন এক্সচেঞ্জও। মডার্নের সৈকত দে-র মতে, নিলামঘরগুলির আয়ু বড় জোর আর বছর কুড়ি। তার পর ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হবেন তাঁরা।

আরশাদ জানাচ্ছেন, তাঁদের দুই ভাইয়ের সন্তানেরা কেউ এই ব্যবসায় উৎসাহী নয়। তাঁদের পরেই যে রাসেল এক্সচেঞ্জের পথ চলা শেষ, তা জানানোর সময়ে বিষাদের ছোঁয়া লাগে তাঁর গলায়। তবে তা পরক্ষণেই কাটিয়ে ওঠেন তিনি। এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল নয়, সেই দেওয়াল লিখন যে অনেক আগেই পড়ে ফেলেছেন তাঁরা।

তবে কিছু ক্রেতা এখনও নিয়মিত ফিরে ফিরে আসেন। ‘ওল্ডেস্ট ইয়াং কাস্টমার’ বলে আরশাদ আলাপ করিয়ে দিলেন অভিষেক হরিতবালের সঙ্গে। অধুনা জয়পুর নিবাসী অভিষেকের শখ পুরনো ঘড়ি। এ শহরে এলেই নিয়ম করে ঢুঁ মারেন নিলামঘরে। এ বারে তাঁর চোখ পড়েছে এক মার্কিন কোম্পানির ম্যান্টল ক্লকের উপরে।পোর্সেলিনের একটা প্লেট দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এটা কিন্তু পুরনো নক্সার অনুকরণে বানানো নতুন জিনিস।’’ কী ভাবে বোঝেন এ সব? ‘‘রঙ, নির্মাতার ছাপ আর সবচেয়ে বড় সম্বল অবশ্যই অভিজ্ঞতা’’— ‌হাসেন অভিষেক।

আর এক নিয়মিত ক্রেতা আনন্দ তোশাওয়ার আক্ষেপ করছিলেন একটা স্যুপের বাটির সেট ফস্কে গেল! নিলাম চলাকালীন সেগুলি হাতে নিয়ে দেখতে গিয়ে ধমকও খেলেন। কারণ কেনার আগে সব ভালো করে যাচাই করে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট দিন শনিবার।

আরশাদ শোনালেন অনেক দিন আগের এক কাহিনী। একটি কাট গ্লাসের ডিক্যান্টার নিয়ে লড়াই জমেছিল এক ব্রিটিশ ও রাজস্থানী দম্পতির মধ্যে। শেষমেশ সেটি কেনেন ওই রাজস্থানী দম্পতিই। পরে জানা যায়, রান্নার তেল রাখার জন্য ব্যবহার হবে সেটি।

এমনই সব গল্প জমানো নিলামঘরগুলিতে। সেখান থেকে বেরোলেই দেখা যায় কয়েক দশকের পুরনো বাড়ির পাশেই মাথা তুলেছে মেঘ-ছোঁয়া, কাচে মোড়া বহুতল। দ্রুত বদলাচ্ছে এই শহর। হারিয়ে যাচ্ছে পরিচিত বহু কিছু। আর তাই যেন পুরনো গ্ল্যামারের শেষ রেশটুকু গায়ে মেখে ফের দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে কলকাতার নিলামঘর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement