রেড রো়ডের শোভাযাত্রা শেষে পুলিশই পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাজে কদমতলা ঘাটে। কিন্তু ঘাটের সামনে বাঁশের ব্যারিকে়ডের কাছে পৌঁছতেই দক্ষিণ কলকাতার পুজো কমিটির সদস্যদের পথ আটকাল সেই পুলিশই!
বাঁশের ব্যারিকেডের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দু’জন পুর অফিসার। ক্লাবের সম্পাদককে ডেকে তাঁদের এক জন বললেন, ‘‘এ বার প্রতিমা নিয়ে যাবেন কুলিরা। আপনাদের তিন-চার জন আমাদের সঙ্গে গঙ্গায় যেতে পারবেন।’’
গত কয়েক বছর ধরে এটাই কলকাতার বিসর্জনের রীতি। এ বার তা আরও কড়া করেছিল পুরসভা ও পুলিশ। গত কয়েক বছর বিসর্জনের সময়ে গঙ্গায় ডুবে যাওয়ার ঘটনা অনেকই কমে গিয়েছে। পুজো কমিটির কর্তারাই বলছেন, বিপদ তো ঘটেইনি, নিরাপত্তার কড়াকড়িতে এ বারে বিসর্জন আরও মসৃণ হয়েছে।
হোসপাইপে বিসর্জন দিয়ে দূষণবিরোধী মডেল গড়েছে নৈহাটি। আর নিরাপদ বিসর্জনের মডেল তৈরির পালক জুড়েছে কলকাতা পুরসভা ও পুলিশের মাথায়। শহর লাগোয়া বিভিন্ন জায়গাতেও ‘কলকাতা মডেল’ অনুসরণ করেছে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন।
লালবাজারের খবর, প্রতি বছরের মতো এ বারও বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট ১৭টি ঘাটে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা ছিল। তৈরি হয়েছিল বাঁশের ব্যারিকেড। সেখানেই ভিড় আটকে দেওয়া হয়েছিল। ঘট বিসর্জন এবং প্রতিমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকার জন্য হাতেগোনা কয়েক জন কর্মকর্তাকে ব্যারিকেডের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল। রাখা হয়েছিল বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী এবং জলে পুলিশি টহলদারি। উপরন্তু এ বার ঘাটগুলিকে আগাপাশতলা জোরালো আলোয় মুড়ে দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। তার ফলে অনেক জোরালো হয়েছিল নজরদারিও।
তবে এ বারের মসৃণ বিসর্জনের পিছনে রেড রোডের শোভাযাত্রার বিশেষ ভূমিকার কথা বলছেন পুরসভার কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, প্রতি বছর শহরের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন বড় বড় পুজো কমিটি বিরাট শোভাযাত্রা করে, শ’য়ে শ’য়ে লোক নিয়ে এসে গঙ্গার ঘাটে হাজির হয়। সমন্বয় কম থাকায় অনেক সময়ে ভিড়ও লেগে যায়। তাড়াহুড়োতে বিপদের আশঙ্কা থাকে। এ বার রে়ড রোডের শোভাযাত্রায় শহরের ৩৯টি পুজো কমিটি এসেছিল। নির্দিষ্ট সংখ্যক ট্যাবলো এবং লোকজন নিয়ে এসেছে তারা। কোন পুজো কখন আসছে, তা-ও আগেভাগে জানা ছিল। ‘‘ফলে গোটা প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত মসৃণ ভাবে মিটেছে,’’ দাবি করছেন পুরসভার এক অফিসার।
পুর-কর্তৃপক্ষের মতে, এ বার বিসর্জন ধাপে ধাপে হওয়াতেও সুবিধা হয়েছে। যেমন দশমীর দিন বাড়ি ও বারোয়ারি পুজো মিলিয়ে ১৫০০ প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল। বৃহস্পতিবারও প্রচুর ঠাকুর বিসর্জন হয়েছে। ফলে এক সঙ্গে চাপ এসে পড়েনি। পুরসভার এক কর্তা বলছেন, এ বার বড় পুজোগুলি রে়ড রোডের শোভাযাত্রার জন্য প্রতিমা রেখে দিয়েছিল। বাকিরা নিজেদের সুবিধা মতো বিসর্জন দিয়েছে। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার বলছেন, ‘‘সব কিছুর মধ্যে সমন্বয় থাকার ফলেই এ বার বিসর্জন নির্বিঘ্নে মিটেছে।’’
এ বার থেকে বাঁশের ব্যারিকেড, কুলির ব্যবস্থা করেছিল বিধাননগর, দমদম ও দক্ষিণ দমদম পুরসভাও। নিউ টাউনের মায়ের ঘাটে গত বছর বিসর্জন নিয়ে গোলমাল বেধেছিল। এ বার তাই শুরু থেকেই ওই ঘাটে বিসর্জন দিতে যাওয়া পুজো কমিটিগুলিকে রুট ম্যাপ ও সময় বলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ভিড় হয়নি। বাগুইআটির রেলপুকুর, বাগুইপাড়ার পুকুর, দমদম পুরসভার ধোপাপুকুরেও বিসর্জন দিয়েছেন মূলত পুরসভা নিযুক্ত কুলিরাই। ভিআইপি রোডের পাশে দেবীঘাটেও ব্যারিকেড দিয়ে পুজো কমিটিকে আটকে দেওয়া হয়েছিল। সল্টলেকের অনেক পুজো প্রতিমা নিয়ে গঙ্গায় পাড়ি দিয়েছে।
মহেশতলা, বজবজ, রবীন্দ্রনগর থানা এলাকাতেও এ বার বিসর্জন দুর্ঘটনাশূন্য। প্রশাসন সূত্রের খবর, বিসর্জন নিয়ে এ বার পুজোর মাস খানেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পুজো কমিটিগুলিকে বিসর্জনের নির্দিষ্ট সময় ও রুট বাতলে দেওয়া হয়েছিল। শোভাযাত্রায় কোনও গোলমাল সহ্য করা হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। বিসর্জনের সময়ে পুজো কমিটিকে জলের থেকে শত হস্ত দূরে রাখা হয়েছিল। প্রতিমা জলে ফেলার দায়িত্ব ছিল কুলিদের কাঁধেই। পুর-কর্তারাও রাতভর হাজির ছিলেন। বজবজ পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান গৌতম দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘পুলিশের পাশাপাশি আমরাও নজরদারি চালিয়েছি। সবাই একসঙ্গে কাজ করায় বিসর্জন পর্ব নিরাপদেই মিটেছে।’’