স্কুল ও কলেজে মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ

কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যায় শালিনীর। অফিসের গাড়ি পৌঁছে দিলেও, রাস্তার পরের গলিপথটুকু হেঁটেই যেতে হয়। মোড়ের মাথায় জটলাটা থেকে রোজই উড়ে আসে মন্তব্য, কু-ইঙ্গিত। দাঁত কিড়মিড় করলেও কোনও দিনই প্রতিবাদ করা হয় না। ভয়ে। ভয়টাই যে সব চেয়ে বড় দুর্বলতা, দিব্যি বোঝে শালিনী। কিন্তু কাটিয়ে ওঠার পথ জানা নেই।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৪০
Share:

আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার তত্ত্বাবধানে ভিক্টোরিয়া কলেজে চলছে প্রশিক্ষণ। — নিজস্ব চিত্র।

কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যায় শালিনীর। অফিসের গাড়ি পৌঁছে দিলেও, রাস্তার পরের গলিপথটুকু হেঁটেই যেতে হয়। মোড়ের মাথায় জটলাটা থেকে রোজই উড়ে আসে মন্তব্য, কু-ইঙ্গিত। দাঁত কিড়মিড় করলেও কোনও দিনই প্রতিবাদ করা হয় না। ভয়ে। ভয়টাই যে সব চেয়ে বড় দুর্বলতা, দিব্যি বোঝে শালিনী। কিন্তু কাটিয়ে ওঠার পথ জানা নেই।

Advertisement

এই ভয় কাটানোর খোঁজ দিতেই সম্প্রতি কালীঘাটের উইমেনস ক্রিশ্চান কলেজে এসে ঘণ্টা তিনেকের কর্মশালা করে গেলেন ‘সেভেন্থ চক্রজ আর্ট ফর সেল্ফ প্রিজারভেশন’ নামের মার্শাল আর্টস সংস্থার মুখ্য প্রশিক্ষক সাত্যকি গুপ্ত। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দলের সদস্য প্রাজ্ঞ, গৌরব, শ্রাবণী, সন্দীপন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে আত্মরক্ষার ছোট ছোট কৌশলগুলি হাতেকলমে শিখে নিলেন কলেজপড়ুয়া তরুণীরা। শিখলেন, ‘‘চুপ থেকো না। তোমার স্বরও প্রয়োজনে অস্ত্র হতে পারে।’’

উইমেনস ক্রিশ্চান কলেজের অধ্যক্ষা ডক্টর অজন্তা পাল জানালেন, ‘ইউনাইটেড বোর্ড ফর খ্রিস্টান হায়ার এডুকেশন অব এশিয়া’-র বৈঠকে মেয়েদের আত্মরক্ষা নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচির প্রস্তাব রাখা হয় কলেজের উইমেনস স্টাডি সেলের তরফে। বোর্ড তা মঞ্জুর করে।

Advertisement

সাত্যকি জানালেন, মার্শাল আর্টসের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতে গেলেই যে নির্দিষ্ট পোশাক পরে, দুমদাড়াক্কা হাত-পা ছুঁড়ে, মুখ দিয়ে শব্দ করে মারধর করতে হবে, তা কিন্তু নয়। ‘‘যে মহিলা সারা দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরেন, তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বও তিনি যাতে নিজে নিতে পারেন, সেটাই চেষ্টা করি আমরা।’’— বললেন তিনি। তাঁর প্রশিক্ষণ পেলে হাতের পার্স, ব্যাগে রাখা জলের বোতল বা পায়ের জুতোও আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠতে পারে।

তবে অস্ত্র ব্যবহার করার আগেই যাতে বিপদ আঁচ করে তা এড়ানো যায়, সেটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে জানালেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ জ্ঞান আর উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই খারাপ পরিস্থিতি অনেকটা সামলানো যায়। প্রয়োজন শুধু একটু সচেতনতা, গাইডেন্স।’’

এই সচেতনতাই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য বলে জানালেন উইমেনস স্টাডি সেলের যুগ্ম কোঅর্ডিনেটর প্রিয়দর্শিনী সরকার। বললেন, ‘‘একটা কর্মশালা করেই এক জন ছাত্রী চারটে দুষ্টু ছেলেকে সিনেমার মতো মারধর করে শুইয়ে দেবে, এতটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা চাই, নিজের শক্তি যাচাই করে নিক তাঁরা। সাহস বাড়ুক, আত্মবিশ্বাস বাড়ুক। যে কোনও পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়ানোর মনোবলই ছাত্রীদের জোগাতে চাই।’’

তবে এই কলেজই প্রথম নয় কলকাতায়। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মেয়েদের মধ্যে আত্মরক্ষা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে কলকাতা পুলিশ। ২০১৪ সাল থেকে ‘কন্যাশ্রী’-র অনুপ্রেরণায় শুরু হয় ‘সুকন্যা’ প্রকল্প। মেহবুব রহমান, যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) ও সহকারী কমিশনার শোভেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে এগিয়ে চলেছে প্রকল্পটি। এর অধীনে কলকাতার বিভিন্ন স্কুলে ও কলেজে ছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত চর্চা চলছে মার্শাল আর্টসের। উদ্দেশ্য আত্মরক্ষা। প্রশিক্ষণের বিনিময়ে কোনও টাকাও দিতে হয় না পড়ুয়াদের।

কলকাতা পুলিশের সহকারী কমিশনার শোভেন বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ২০১৪ সালে সারা শহরের মাত্র ৬৩০ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল ‘সুকন্যা’। এখন কলকাতার ৬২টি স্কুলের মোট তিন হাজারেরও বেশি ছাত্রী এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মোট ছ’টি প্রশিক্ষণ সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছে কিক বক্সিং, মিক্সড মার্শাল আর্টস, আইকিডো, তাইকোন্ড, জুডো ইত্যাদি বিভিন্ন রকম মার্শাল আর্টসের মাধ্যমে ছাত্রীদের আত্মরক্ষায় পারদর্শী করে তুলতে। রাজ্য সরকার বার্ষিক ৩০ লক্ষ টাকা করে খরচ করছে এই প্রকল্পে। তিনি বললেন, ‘‘মেয়েরা নিজের শক্তির উপরে ভরসা রেখে মাথা তুলে দাঁড়াক। আত্মরক্ষা তো বটেই, মেয়েদের আত্মবিশ্বাসও এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিতে পারে মার্শাল আর্টসের প্রশিক্ষণ।’’

‘সুকন্যা’-র সঙ্গে প্রায় শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছে এ রকমই একটি প্রশিক্ষণ সংস্থা ‘থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি স্পোর্টস’। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা পার্থসারথি সরকার এবং সুপ্রিয়া সামন্ত দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছেন এই স্পোর্টসে। তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে পার্থসারথি জানালেন, মেয়েদের যে সমস্ত কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, তার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কিছু বিশেষ সহজ আত্মরক্ষার পদ্ধতি (সেল্ফ ডিফেন্স) শেখানো হচ্ছে এই প্রকল্পে। উদ্দেশ্য, খুব বেশি না-খেটেও যেন আত্মরক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠে প্রতিটি মেয়ে।

কিন্তু বাস্তবে সে রকম চরম পরিস্থিতিতে পড়লে একটা মেয়ের পক্ষে সত্যিই কি নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব শুধু কয়েক রকম শারীরিক কসরতের মাধ্যমে? বিশেষ করে যখন তার উল্টো দিকে রয়েছে এক বা একাধিক সমর্থ পুরুষ?

সুপ্রিয়া বললেন, “মিক্সড মার্শাল আর্টসের খুব সহজ অথচ কার্যকর কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করি আমরা। যেগুলো কাজে লাগানোর জন্য দরকার নেই বিশাল চেহারার, দরকার নেই দীর্ঘ সময়ের অভ্যাসেরও। শরীরের বিভিন্ন হাড়ের সংযোগস্থলগুলিকে মূল লক্ষ্য করা হয়। সুতরাং সামান্য অ্যানাটমি জ্ঞান আর তার সঙ্গে একটু টেকনিক। ব্যাস, কেল্লা ফতে।” মেয়েরা সাধারণত যে ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়ে, শুধু সেগুলির কথা মাথায় রেখেই ছাত্রীদের নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতির চর্চা করা হচ্ছে এই প্রকল্পে। যেমন মেয়েটি যদি মাটিতে পড়ে যান, তাঁর উপরে চ়ড়ে বসে দুষ্কৃতী, সে অবস্থা থেকেও বিশেষ কিছু টেকনিকে দুষ্কৃতীকে অজ্ঞান পর্যন্ত করে ফেলতে পারেন মেয়েটি।

কিন্তু যাঁদের জন্য এই প্রকল্প, অর্থাৎ মেয়েরা— তারা কতটা এগিয়ে আসছে এই ব্যাপারে?

ছাত্রীরা বেশ ভালই আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে জানালেন পার্থসারথি। তিনি যেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে মার্শাল আর্টস শেখান, সেই তালিকায় যেমন আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান, তেমনই আছে উত্তর কলকাতার আদি মহাকালী পাঠশালাও। পার্থসারথি বললেন, “ইভ-টিজিং বা যৌন নিগ্রহের ঘটনাগুলি তো সমাজের বিশেষ কোনও শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে আটকে নেই। এড়ানোরও উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে অন্যকে মারার থেকেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজেকেই শক্তিশালী হতে হবে মেয়েদের।”

উইমেনস ক্রিশ্চান কলেজের সোশিওলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী রিয়াঙ্কা দত্তও বললেন সে কথাই। ‘‘মেয়েদের মার্শাল আর্টস শেখা মানেই ছেলে-পেটানো নয়। খারাপ পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারি, সেই মনের জোরটা তৈরি করতে চাই।’’

মার্শাল আর্টসের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াতে তৈরি মেয়েরা। তাঁদের তিলতিল করে জমিয়ে নেওয়া আত্মবিশ্বাস শহরের হেনস্থা-চিত্র কি এমনি করেই কোণঠাসা হবে? উত্তর সময়ের অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন