'শাস্তি আমরাও চাই, তা বলে ম্যামদের জুতো দেখাবে কেন'

একই সঙ্গে কমলিনীদের স্পষ্ট বক্তব্য, এই ঘটনার জেরে স্কুল থেকে সমস্ত পুরুষ শিক্ষককে সরিয়ে দেওয়ার দাবি একেবারেই যুক্তিসঙ্গত নয়। দোষটা সকলের নয়। ঠিক যেমন যুক্তিসঙ্গত নয়, স্কুলের শিক্ষিকাদের আটকে রেখে জুতো দেখানো, অশ্লীলতম ভাষায় গালাগালি করা অথবা স্কুল বিল্ডিংয়ের গায়ে ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ ফ্যাক্টরি’ লেখা পোস্টার সেঁটে দেওয়া।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৪৮
Share:

‘‘—বাবা, পশু কাকে বলে, আমায় পশু দেখাবে?

Advertisement

—হ্যাঁ বাবা, দেখাব। চলো, জিডি বিড়লা স্কুলের স্টাফরুম দেখিয়ে আনি তোমায়। ওখানে অনেক পশু আছে।’’

এ রকমই একটা ‘রসিকতা’ প্রকাশিত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। স্বাভাবিক ভাবেই, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাইরাল। এবং শুধু তা-ই নয়, সঙ্গ দিচ্ছে ব্যক্তিগত স্তরে নানা রকম কাদা ছোড়াছুড়িও। কখনও কদর্য অপমানের মুখে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পরিবার, সন্তান। কখনও বা আক্রমণের মুখে স্কুলের সাধারণ পড়ুয়ারাও। শুধু সোশ্যাল মিডিয়াই নয়, সম্ভবত গত কয়েক দিনে এ শহরের সমস্ত জায়গায় সর্বাধিক আলোচিত বিষয় জি ডি বিড়লা স্কুলে চার বছরের এক ছাত্রীর উপরে দুই শিক্ষকের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ।

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘স্বীকারোক্তি’, পুলিশি দাবি

কিন্তু এ সব কিছুর মাঝে কেমন আছে, স্কুলের সাধারণ পড়ুয়ারা, যারা আর পাঁচ জনের মতোই এত দিন ভালবেসেছে নিজের প্রিয় স্কুলকে, সম্মান করেছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের? যারা স্কুল কর্তৃপক্ষকে কোনও ভাবে সমর্থন না করলেও, মনেপ্রাণে চাইছে স্কুলের অবস্থা স্বাভাবিক হোক?

‘‘ছোট্ট বোনটার জন্য আমরাও কাঁদছি। দোষীদের কঠোরতম শাস্তি আমরাও চাই। ঘটনার পরেই কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়ায় যে অসংবেদনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে, তার তীব্র প্রতিবাদ আমরাও করছি। কিন্তু প্রতিবাদের আবরণে যে অপরিসীম ‘অসভ্যতা’ চলছে অভিভাবকদের তরফে, যে ভাবে স্কুলকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে, যে ভাবে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অপমান করা হচ্ছে, তাকে সমর্থন করি না।’’— এমনটাই বলছেন জি ডি বিড়লা স্কুলের উঁচু ক্লাসের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা।

দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী কমলিনী মুখোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছে, সে তিন বছর বয়স থেকে এই স্কুলে পড়ছে। বাড়ির পরেই যদি কোথাও সব চেয়ে বেশি নিরাপদ লাগে, তবে তা এই স্কুলই। ‘‘আমিও ছোটবেলা থেকেই পুরুষ শিক্ষকদের কাছেই শারীরচর্চা করেছি স্কুলে। আমার বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হয়নি কখনও। কিন্তু আমাদের ছোট্ট বোনটার ক্ষেত্রে এমনটা হল না, এই একই স্কুলে। তীব্র নিন্দা রইল, কঠোর শাস্তির দাবি রইল।’’— বলছে কমলিনী।

দ্বাদশ শ্রেণিরই কলা বিভাগে আর এক ছাত্রী বলছে, ‘‘এই ক’টা দিন আমরা ভাল করে ঘুমোতে পারছি না। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক বাড়ছে, আমাদের প্রিয় ম্যামেরা ঠিক আছেন তো?’’। পাশাপাশি, অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তির দাবি জানিয়েই তিনি বলছেন, ‘‘এত বড় একটা কাণ্ড ঘটানোর পরে আর কোনও যুক্তিই থাকে না বলার মতো।’’

একই সঙ্গে কমলিনীদের স্পষ্ট বক্তব্য, এই ঘটনার জেরে স্কুল থেকে সমস্ত পুরুষ শিক্ষককে সরিয়ে দেওয়ার দাবি একেবারেই যুক্তিসঙ্গত নয়। দোষটা সকলের নয়। ঠিক যেমন যুক্তিসঙ্গত নয়, স্কুলের শিক্ষিকাদের আটকে রেখে জুতো দেখানো, অশ্লীলতম ভাষায় গালাগালি করা অথবা স্কুল বিল্ডিংয়ের গায়ে ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ ফ্যাক্টরি’ লেখা পোস্টার সেঁটে দেওয়া। ‘‘শাস্তি আমরাও চাই, তা বলে ম্যামদের জুতো দেখাবে কেন?’’— বলছে এক ছাত্রী।

তৃতীয় শ্রেণির আর এক খুদে আবার স্বাভাবিক ভাবেই বুঝে উঠতে পারেনি ঘটনার গুরুত্ব। কিন্তু টিভির পর্দায়, অভিভাবকদের জুতোর মুখে প্রিয় শিক্ষিকাদের অসহায় মুখ দেখে কান্না থামছে না তার। বারবার বলছে, ‘‘কবে যেতে পারব ম্যামের কাছে।’’ একই ভাবে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে প্রথম শ্রেণির সিয়ানা রায়। বারবার বলছে, ‘‘স্কুলে কী হয়েছে? ওই বেবিটা কেমন আছে? আমি কিন্তু যাব না স্কুলে।’’

কমলিনী জানিয়েছে, সব দাবি যৌক্তিক না হলেও, নিরাপত্তার স্বার্থে স্কুলে সিসিটিভি বসানোর যে দাবি উঠেছে অভিভাবকদের তরফে, তা জরুরি বলেই মনে করে তারা। কিন্তু এই দাবি প্রকাশের পদ্ধতি একেবারেই কাম্য নয়। কমলিনীর প্রশ্ন, ‘‘আমার স্কুলের গায়ে যদি সাঁটা হয় ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ ফ্যাক্টরি’, তবে আমি কী ভাবে সেখানে আগের মতোই ঢুকব সেখানে? আমি নিজের চোখে দেখছি, যে ম্যামেদের কাছে ছোটবেলা থেকে পড়েছি, ভালবাসা পেয়েছি, তাঁদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছেন আমাদেরই বাবা-মায়েরা! এই স্কুলকে কী করে ভালবাসব একই ভাবে!’’

এই ক’দিনে তৈরি হওয়া ‘পাশে আছি জিডি বিড়লা’ প্রচারেরও বিরোধিতা করছে তারা। তাদের দাবি, ২০১৪ সালে যে ঘটনার ভিত্তিতে এই প্রচার শুরু হয়েছিল, সে ঘটনায় স্কুলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ভুয়ো অভিযোগ উঠেছিল। তাই স্কুলের পাশে থাকাটা প্রয়োজন ছিল। ‘‘কিন্তু এই বার যা হয়েছে, তাতে পাশে থাকার কোনও প্রশ্নই নেই। দোষী শিক্ষকদের শাস্তি এবং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সত্যিই জরুরি। ফলে ‘পাশে আছি’ ট্রেন্ডে গা-ভাসানো নেহাৎই অন্ধত্বের পরিচয়।’’— বলছে কমলিনী।

দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র দেবদত্ত চট্টোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, শুধু পুরুষ হওয়ার কারণে এবং জিডি বিড়লায় পড়ার কারণে, ঘটনার পরের দিন বিক্ষোভকারী অভিভাবকেরা ঘিরে ধরেন তাকে এবং তার বন্ধুদের। ‘‘আমরা ইউনিফর্ম পরে ছিলাম, স্কুলের আই কার্ডও ঝুলছিল গলায়। তবু আমাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, শার্ট ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলা হয়েছিল ‘ধর্ষক’। আমরা রীতিমতো সন্ত্রস্ত। দু’জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঘন্য অভিযোগ ওঠার কারণে, আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রদের তো এ ভাবে আক্রান্ত হওয়ার কথা ছিল না!’’— বলছে দেবদত্ত।

অন্য দিকে, সোমবার এ ভাবেই আতঙ্কের মুখে পড়েছে এমপি বিড়লা স্কুলের খুদেরাও। মাস তিনেক আগে এক ছাত্রীর যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলে এ দিন স্কুলের সামনে বিক্ষোভ-অবরোধ করেন অভিভাবকেরা। সে কারণেই পৌনে এগারোটায় মর্নিং সেকশন ছুটি হওয়ার পরেও আটকে রাখা হয় বাচ্চাদের। পরে পিছনের গেট দিয়ে অভিভাবকদের হাতে একে একে ছা়ড়া হয় তাদের। সময় তখন সাড়ে বারোটা। ছুটির পরেও প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে স্কুলে আটকে থেকে স্বাভাবিক ভাবেই শঙ্কিত তারা।

এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘সব রকম প্রতিবাদই প্রয়োজন। কিন্তু বাচ্চাদের ভালর জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি বাচ্চাদেরই ক্ষতি হয়, তবে তা মেনে নেওয়া যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন