ব্যারিকে়ড ভাঙতেই লাঠির ঘায়ে মিছিলের রক্তস্নান

এলোমেলো ছুটে বেড়াচ্ছেন এক দল ছেলে-মেয়ে। পিছনে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করছে পুলিশ। হাতের সামনে যাঁকে পাচ্ছে, তাঁকেই ধরে পেটাচ্ছে। আর লাঠি খেয়ে কারও মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, কারও মুখ ক্ষতবিক্ষত। কেউ রাস্তার ডিভাইডারের রেলিং ধরে এলিয়ে পড়েছেন। কেউ পড়ে আছেন রাস্তার উপরে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৭
Share:

এলোমেলো ছুটে বেড়াচ্ছেন এক দল ছেলে-মেয়ে। পিছনে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করছে পুলিশ। হাতের সামনে যাঁকে পাচ্ছে, তাঁকেই ধরে পেটাচ্ছে।

Advertisement

আর লাঠি খেয়ে কারও মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, কারও মুখ ক্ষতবিক্ষত। কেউ রাস্তার ডিভাইডারের রেলিং ধরে এলিয়ে পড়েছেন। কেউ পড়ে আছেন রাস্তার উপরে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে এই দৃশ্যটি দেখা গিয়েছে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায়, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে। ওই তরুণ-তরুণীরা বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সদস্য-সমর্থক। দু’বছর আগে, ২০১৩-র ২ এপ্রিল আইন অমান্য আন্দোলন থেকে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পথে এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের অপমৃত্যু হয়েছিল। পুলিশ তখন দাবি করেছিল, বাসের দরজায় ঝুলতে-ঝুলতে যাওয়ার সময় ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে সুদীপ্ত মারা গিয়েছেন। ওই ঘটনায় দায়ের তিনটি মামলায় বাসের চালক ও খালাসির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে এসএফআই নেতাদের অভিযোগ, সে দিন পুলিশের হাতেই সুদীপ্তকে মরতে হয়েছে।

Advertisement

সেই সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুর প্রতিবাদ, অভিযুক্তদের শাস্তি ও ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিতে এ দিন কলেজ স্কোয়্যার থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মিছিলের ডাক দিয়েছিল এসএফআই। সেখানেই বাঁধল দক্ষযজ্ঞ। কী ভাবে?

বেলা দু’টো নাগাদ শুরু হওয়া মিছিল সওয়া তিনটেয় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছলে দেখা যায়, রাস্তা আটকে পুলিশ দাঁড়িয়ে। প্রথম স্তরে খাকি ও সাদা পোশাকের সাধারণ পুলিশকর্মী-অফিসারেরা। তাঁদের পরে গার্ডরেল। শেষ স্তরে ছিলেন ডিসি (সেন্ট্রাল) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ-সহ পদস্থ অফিসারেরা। সব শেষে র‌্যাফ। মিছিল এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ধাক্কাধাক্কিতে গার্ডরেল উল্টে যায়। মিছিলকারীদের কেউ কেউ পুলিশের লাঠি ধরে টান দেন। পুলিশকে ধাক্কাও মারা হয়।

এর পরেই পুলিশ এলোপাথাড়ি লাঠি চালাতে শুরু করে। গোলমালের মধ্যে দেখা যায়, বিদ্যাসাগর মর্নিং কলেজের ছাত্রী স্বাগতা কুণ্ডুকে ধরাধরি করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। এসএফআই কর্মী সঞ্জিত দে’র মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরছে। সংগঠনের রাজ্য নেতা সৌমেন মিত্রের চোখের কোল ফেটেছে।
রাজ্য কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অয়ন বসুকে ভর্তি করা হয়েছে উত্তর দমদম পৌর হাসপাতালে। অয়নের অভিযোগ, বিনা প্ররোচনাতেই পুলিশ লাঠি চালিয়েছে।

আহত ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশকে কলকাতা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ঢুকে চোখে পড়ে, অনেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। কেউ কেউ বমি করছেন। ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের ছাত্রী সুদেষ্ণা দে-র অভিযোগ, ‘‘পুরুষ পুলিশও মেয়েদের গায়ে-মাথায়-মুখে-বুকে লাঠি চালিয়েছে।’’ মাটিতে বান্ধবীর ঘাড়ে মাথা দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিলেন সাউথ সিটির প্রাক্তন ছাত্রী দেবশ্রী মিত্র। পাশে
শুয়ে ক্রমাগত বমি করে যাচ্ছিলেন দক্ষিণ বারাসত কলেজের রণজিৎ হালদার। সুরেন্দ্রনাথের ছাত্র শিল্পক দাসের নাকে অক্সিজেনের নল। বললেন, ‘‘সামনের ব্যারিকেড ভাঙতেই পুলিশ মোটা ফাইবার গ্লাসের লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে লাগল। আমাকে মাটিতে ফেলে এক জন মারল লাঠি দিয়ে। আর এক জন হেলমেট দিয়ে বুকে-পিঠে মারল।’’

প্রতিবাদে সরব হয়েছেন এসএফআই নেতৃত্ব। ‘‘পুলিশ এ দিন প্রমাণ করল, তারা শাসকদলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।’’— মন্তব্য করেছেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, আজ, শুক্রবার দুপুর একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পথ অবরোধের ডাক দিয়েছে বাম ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি। বাম নেতাদের ইঙ্গিত, শ্যামবাজার, হাজরা, মৌলালি ও যাদবপুরে অবরোধ হতে পারে। পুলিশ কী বলছে?

এ দিন সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ। তাঁর বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি এ দিন শহরে ছিলেন। তাই মিছিলের অনুমতি চাওয়ার সময়েই উদ্যোক্তাদের মিছিলের দিন পাল্টাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু বাম ছাত্র নেতারা রাজি হননি। আইন অমান্য আন্দোলনের দস্তুরমাফিক গ্রেফতারের পরিকল্পনাও তাঁদের আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে সিপি’র দাবি। পুলিশকে লাঠি চালাতে হল কেন?

সিপি-র অভিযোগ: শান্তিপূর্ণ মিছিলের মাঝে হঠাৎই মিছিলকারীদের একাংশ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগনোর চেষ্টা করেন। পুলিশের দিকে ইট, বোতল ছোড়া হয়, যাতে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার অতিরিক্ত ওসি মনোজ ঝা ও চার মহিলা পুলিশ-সহ ৯ জন পুলিশকর্মী জখম হয়েছেন। এঁদের দু’জন হাসপাতালে। নিজের দাবির সমর্থনে সিপি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ-ও দেখান। তাতে অবশ্য পুলিশের লাঠি চালানোর ছবি চোখে পড়েনি।

প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যকে ঘেরাওমুক্ত করে লাঠিচার্জের ঘটনার পরেও একই ভাবে পুলিশের তোলা ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার। সেখানে পুলিশি মারধরের ছবি না-থাকলেও আন্দোলনকারীদের কয়েক জনকে পুলিশের দিকে মারমুখী ভাবে ছুটে যেতে দেখা গিয়েছিল। যাদবপুর-কাণ্ডের পরেও সুরজিৎবাবু দাবি করেছিলেন, পুলিশ নিরস্ত্র ছিল। এ দিনও তাঁর দাবি, ‘‘ধর্মতলায় পুলিশের হাতে লাঠি ছিল না। আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের উদ্ধার করতে পরে বাড়তি বাহিনী যায়।’’ কিন্তু হাতে লাঠি না-থাকলে পুলিশ পেটাল কী দিয়ে?

লালবাজারের কর্তাদের ব্যাখ্যা: আক্রান্ত পুলিশদের উদ্ধার করতে পরে যে ফোর্স পাঠানো হয়, তাদের কাছে লাঠি ছিল। যদিও মিছিল আসার অনেক আগেই লাঠিধারী পুলিশ ও র‌্যাফ-কে ঘটনাস্থলে মোতায়েন দেখা গিয়েছে।

এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, প্ররোচনা এড়িয়ে পুলিশ কি শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিল সামলাতে পারত না?

প্রাক্তন কিছু পুলিশকর্তা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে পুলিশের আরও সংযম দেখানো উচিত ছিল। পাল্টা মতও আছে। যেমন কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অনিল জানার কথায়, ‘‘এসএফআই সমর্থকেরাই পুলিশকে প্ররোচিত করেছেন। মনে রাখতে হবে, পুলিশের ধৈর্যেরও সীমা আছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন