ডব্লিউ সি ব্যানার্জি স্ট্রিট

এখনও বজায় আছে ষোলোআনা বাঙালিয়ানা

রাস্তার ধারে সার দিয়ে রাখা শোভাযাত্রার বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, পাশ দিয়ে অবিরাম ছুটে চলে যানবাহন। গলদঘর্ম হয়েও গলির মুখে ক্রিকেটে মশগুল ছোটদের উল্লাস। এই টুকরো ছবিতেই ধরা আমার পাড়া, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি স্ট্রিট।

Advertisement

শিবনাথ সাধু

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৩
Share:

রাস্তার ধারে সার দিয়ে রাখা শোভাযাত্রার বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, পাশ দিয়ে অবিরাম ছুটে চলে যানবাহন। গলদঘর্ম হয়েও গলির মুখে ক্রিকেটে মশগুল ছোটদের উল্লাস। এই টুকরো ছবিতেই ধরা আমার পাড়া, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি স্ট্রিট।

Advertisement

গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের গা ঘেঁষে শুরু এই রাস্তা সোজা বাঁ দিকে মিশেছে রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে। এক দিকে সাগর ধর লেন, অন্য দিকে,সুধীর চ্যাটার্জি স্ট্রিট। পাশেই ঠাকুরদাস চক্রবর্তী লেন। এই নিয়েই পাড়াটা। সেই ১৯৩৯ সাল থেকে বসবাস এখানে। এ পাড়ার কথা বলতে গেলেই বিশেষ এক অনুভূতি হয়। যাতে মিশে ভালবাসা আর অন্তরঙ্গতা। যদিও পরিবর্তনের জোয়ারে ধীরে ধীরে সেই পাড়াটাই বদলে যাচ্ছে।

এখানে পুরনো বাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় আজও ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের ঝলক মেলে। কিছু বাড়ির চেহারায় বদল এলেও এখানে সে ভাবে থাবা বসায়নি ফ্ল্যাট-সংস্কৃতি। অবাঙালিরা এলেও পাড়ায় বাঙালির সংখ্যাই বেশি। তাই বজায় আছে ষোলোআনা বাঙালিয়ানা।

Advertisement

এখানকার পুরনো বাসিন্দারা বেশির ভাগই হয় প্রয়াত হয়েছেন, নয় পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। তবে যাঁরা এখনও আছেন তাঁদের মধ্যে কিন্তু ভালই যোগাযোগ রয়েছে। বিপদে-আপদে তাঁরা পাশে থাকেন। যদিও এখন রোজের দেখা-সাক্ষাৎ কমেছে। চারপাশে নতুন মুখ দেখে মনে হয় একই পাড়ায় পাশাপাশি থেকেও কত মানুষ অপরিচিতই থেকে যান। আগে এমনটা হত না। নতুন কেউ এলে পুরনোরা গিয়ে আলাপ করতেন।

সেই সময়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও কাকাবাবু, জ্যাঠামশাই, মাসিমা, পিসিমা এই ডাকগুলির জন্য তাঁরাও যেন পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলেন। এখন বুঝি তাঁরা কতটা আগলে রাখতেন ছোটদের। সন্ধ্যার পরে রাস্তায় দেখলেই ধমকে বলতেন, ‘যা পড়তে বস’ কিংবা রাস্তায় একলা দেখলে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘একা একা কোথায় যাচ্ছিস?’ এখন কে কার খোঁজ রাখেন? ‘কেমন আছেন’— এ কথাটা জিজ্ঞাসা করার মতো পড়শির সংখ্যাও কমছে। রাস্তায় দেখা হলেও মোবাইলে মশগুল পড়শিরা পাশ কাটিয়ে চলে যান।

বদলেছে রোজকার অভ্যেসও। আগে ভোর হত কীর্তনের ধ্বনিতে। কাকভোরে এক দল মানুষ কীর্তন করতে করতে পথ পরিক্রমা করতেন। হোস পাইপ দিয়ে রাস্তা ধোয়ার সেই আওয়াজটা আজও কানে ভাসে। এখন সকালটা শুরু হয় গাড়ির আওয়াজ, কোলাহল আর অবাঙালি মিষ্টির দোকানের কচুরি ভাজার গন্ধে।

এখানেও বসেছে জোরালো আলো। নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয়। এলাকার উন্নয়নে কাউন্সিলর তারক চট্টোপাধ্যায় সচেষ্ট। তবে সমস্যাও আছে। যেমন, গাড়ির পার্কিং। দিনে ততটা না থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার রাস্তা জুড়ে পার্কিং থাকায় গাড়ি নিয়ে ঢুকতে-বেরোতে সমস্যা হয়। এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা অবশ্য খুবই ভাল।

এ পাড়ায় সকাল-সন্ধ্যায় কচুরি-শিঙাড়া কিনতে আসা মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। সন্ধ্যার পরে তেলেভাজার দোকানে ভিড় করেন ভোজন রসিকেরা। আর মিষ্টির জন্য তো এ অঞ্চলটা বরাবরই প্রসিদ্ধ। কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত মিষ্টির দোকান।

এ পাড়ায় রাধামাধব গোস্বামীর জোড়া শিবমন্দির রয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িও এ পাড়ায়। এখানে থাকতেন প্রখ্যাত সাঁতারু বিমলকুমার চন্দ্র, বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায়, চিকিৎসক সমরেশ দে, গণিতের প্রখ্যাত শিক্ষক কালীপদ বসু এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবনতারা হালদার।

কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে গড়ে ওঠা ফ্রেন্ডস ইউনাইটেড ক্লাব। শতবর্ষ অতিক্রান্ত এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। ক্লাবের জমি দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সেখানে এখন ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলে, ব্যায়ামও করে। তবে কমেছে খেলাধুলোর অভ্যেসটা।

একে একে পাড়ার রকগুলি উধাও হওয়ায় বদলেছে আড্ডার পরিবেশ। তবে আমাদের গলির মুখে এখনও বিকেল-সন্ধ্যায় প্রবীণেরা বসে আড্ডা দেন। দেখে ভাল লাগে যে আড্ডার রেশটুকু আজও বজায় আছে। এ পাড়ার পুজো-পার্বণও বেশ আকর্ষণীয়। পাড়ার পুজো ছাড়াও কাছাকাছির মধ্যে হয় তিন-চারটি দুর্গাপুজো। আর হয় সুধীর চ্যাটার্জি স্ট্রিটে নবদুর্গার পুজোটি। বাড়ির সামনেই হয় জমজমাট কালীপুজো। পুজোর ক’দিন প্রতিবেশীদের মধ্যে যোগাযোগ হয় বটে, পুজোর পরে
যে কে সেই।

এখনও এ পাড়া শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ। অন্যত্র থাকার সুযোগ এলেও এ পাড়াটা ছাড়তে পারিনি, হয়তো সেই পুরনো আকর্ষণ আর শিকড়ের টানে।

লেখক আইনজীবী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন