সাউথ সিটি মল কর্তৃপক্ষ ওই মাকে বরং ধন্যবাদ দিন

ভারতে দু’টি জিনিসের কোনও অভাব নেই। স্তন্যদানকারী মা আর স্তন্যপানকারী শিশু। ২০১০-এ ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১২৩ কোটি। ২০১৮-য় তা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটিতে এবং এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

Advertisement

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় (লেখিকা)

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৮ ০১:২৪
Share:

প্রকাশ্যে: ফুটপাতে বসেই স্তন্যদান। বৃহস্পতিবার, শোভাবাজার এলাকায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ভারতে দু’টি জিনিসের কোনও অভাব নেই। স্তন্যদানকারী মা আর স্তন্যপানকারী শিশু। ২০১০-এ ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১২৩ কোটি। ২০১৮-য় তা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটিতে এবং এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তার মানে মোট জনসংখ্যার ১০ কোটির বয়স এখনও ৭-৮ বছরের মধ্যে। আমরা শহুরে, শিক্ষিত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী যে মানুষেরা জীবনটা আর্থিক ভাবে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য ও উপভোগ করার জন্য ঝাড়া হাত-পা থাকতে গিয়ে একটি সন্তান নেওয়ার বা একেবারেই সন্তান না নেওয়ার পক্ষপাতী, তারা প্রায়ই ভুলে যাই যে, আমাদের অচেনা আরও একটা ভারত আছে।

Advertisement

সেই ভারত নারীকে এখনও সন্তান উৎপাদক যন্ত্রের বেশি কিছু ভাবে না। সেই ভারতে আজও বহু পরিবারে এক এক জন নারী ১৫-১৬ বছর থেকে ৪০-৪২ বছর বয়স পর্যন্ত পাঁচ-সাতটা করে সন্তান প্রসব করতে বাধ্য থাকে! অগুন্তি সন্তানের যে জননী প্রসব বেদনায় কাতরাতে কাতরাতে ভ্যানরিকশায় চড়ে কাছাকাছি সেবা সদনে ছোটে, তারও দু’টি স্তনবৃন্ত থেকে ঝুলে থাকে দু’টি কচি কচি দুগ্ধপানরত শিশু। দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও তার খাদ্য জুগিয়ে যাওয়ার কর্তব্য থেকে মুক্তি হয় না। এমন ছবি তো বহু দেখেছি আমরা। শিল্পীদের এটি প্রিয় বিষয়। নির্বিকারচিত্ত মা, গৃহকর্মে বা মাঠে চাষের কাজে ব্যস্ত, কিন্তু তার কোলের উপরে হামলে পড়ে দুধ টেনে নিচ্ছে একটি শিশু। এই ভারতবর্ষে মায়েরা পিঠে বাচ্চা বেঁধে জলের বাঁধ তৈরির জন্য মাটি কোপান, এখানে কর্মরতা মেয়েদের একটা বড় অংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত, কোনও সরকারি নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার আওতায় তাঁরা পড়েন না। এই দেশে এত কোটি শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে খিদের চিৎকার, কান্না থামাতে মায়েরা কোথায় আড়াল খুঁজবেন? রাস্তায়-ঘাটে দুধ খাওয়াতে তো তাঁরা বাধ্য। শহরের পথে-ঘাটে কি আমাদের চোখে পড়ে না মায়েরা দুধ খাইয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন বাচ্চাকে? হয়তো একটা আঁচলের আড়াল থাকে। খুব গরীব লোকজনের সেটাও থাকে না। তাঁরা সরাসরি বাচ্চার মুখে স্তন গুঁজে দেন। কে দেখছে তা নিয়ে এঁদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকে না।

এ বার আসল প্রসঙ্গটা এসে পড়ে। এই দেখার প্রসঙ্গটা। এটাই ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে সত্য। এটাই চর্চিত, স্বাভাবিক। এটাই ঘটে। মায়েরা যেখানে-সেখানে দুধ খাওয়ান। কেউ দেখে, কেউ দেখে না। কেউ ভাবে, ‘‘আহা, বাচ্চাটার কী খিদেই না পেয়েছিল!’’ আবার কারও দুধে টইটম্বুর স্তন দেখে কামভাব জাগে। কোটি কোটি মানুষের চেতনে-অবচেতনে কোন বিষয়ের কী প্রক্ষেপণ হবে, তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম হয় না। সমস্যা হচ্ছে, প্রগতিশীল ভারতে যেটা হলে সবচেয়ে ভালো হয় আর যেটা বাস্তবে হওয়া সম্ভব, তার মধ্যে পার্থক্য থেকে যায়। যেমন রাত আড়াইটের সময়ে পার্ক স্ট্রিট থেকে একটি মেয়ে চার জন অচেনা ছেলের সঙ্গে এক গাড়িতে উঠলে স্বাভাবিক অবস্থায় একটু পরে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছনো উচিত মেয়েটির। কিন্তু কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মেয়েই নিরাপত্তা নিয়ে এই ঝুঁকিটা নেয় না। কেন নেয় না? যে কারণে আমরা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে স্বয়ংক্রিয় তালা লাগিয়েও আর একটা তালা ঝুলিয়ে টেনে দেখে নিই, ‘‘চুরি-ডাকাতি হবে কেন, হওয়া তো উচিত নয়’’— বলে দরজা খুলে চলে যাই না, সেই কারণেই রাতে এক জন অপরিচিত ছেলের গাড়িতেও লিফট নেওয়া যায় না।

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘মদ ঠিকই আছে, এই তো খাচ্ছি’

একই কারণে সদ্য মা হওয়া শহুরে একটি মেয়ের বাচ্চা নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে বাচ্চাকে দুধ পান করানোর পূর্ণ যৌক্তিকতা থাকা সত্ত্বেও, প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, অধিকার থাকা সত্ত্বেও সেই বাস্তবটা আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা যে ভারতবর্ষকে রাস্তাঘাটে দুধ খাওয়াতে দেখি, সেই ভারতবর্ষকে তো ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। কিন্তু একটি শহুরে, আধুনিক পোশাক পরা মেয়ে শপিং মলে সর্বসমক্ষে স্তন্যপান করালে অন্যেরা ঠিক কী আচরণ করবেন, কারও তা জানা নেই। হয়তো ভিড় জমে যাবে, মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করবে কেউ। বিদেশে যেমন যেখানে-সেখানে দুধ খাওয়ায় মেয়েরা। ওদের সমাজ তাতেই অভ্যস্ত। ভারতে এখন মেয়েদের অনেক বেশি বাইরে বেরোতে হচ্ছে, দরকারে বাচ্চা নিয়েও বেরোতে হচ্ছে। জনপরিসরেও বাচ্চাকে নিশ্চিন্তে দুধ খাওয়ানোর দাবি নিশ্চয়ই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উঠবে। অচিরেই বিবেচনার মধ্যে আসবে যে এটা স্বাভাবিক ঘটনা।

আরও পড়ুন: ‘স্তন্যপান করান শৌচালয়ে’, বিতর্কের ঝড়ে শপিং মল

সাউথ সিটি মল কর্তৃপক্ষের অভিজ্ঞতার মধ্যে এটা নিশ্চয়ই ছিল না। অবশ্য ওঁরা অনায়াসেই মেয়েটিকে অফিসে নিয়ে গিয়ে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। সেটা হলে বলা যেত মলের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা দক্ষ, সপ্রতিভ। সেটা হয়নি। আপাতত মল কর্তৃপক্ষের উচিত ওই মাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা চিঠি লেখা, একটি ফুলের স্তবকও পাঠানো উচিত। কারণ তাঁদের মল ম্যানেজমেন্টের একটি নতুন দিকের সঙ্গে তাঁরা পরিচিত হলেন মেয়েটির মাধ্যমে। ভবিষ্যতে এই জানাটা তাঁদের কাজে আসবে। হয়তো সেখানে স্তন্যপান করানোর জন্য একটা ঘর পাবে মেয়েরা। আমাদের বেশির ভাগ মলেই এখনও বাচ্চাদের ডায়াপার বদলানোর টেবিল থাকে না, যেটা বিদেশে থাকে। অচিরে এ সবও হবে বলে আশা করা যায়। আমরা সবাই খিদের মুখে শিশুর দুধ খাওয়ার অধিকারকে সমর্থন করি। কিন্তু প্রগতিশীল চিন্তাকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য যে সময় লাগে, সেই সময়টুকু দেওয়ার ধৈর্য যেন আমাদের থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন