পুরো সাত দিন, ২৪ ঘণ্টা। অফিস, দোকানপাট, শপিং মল বা রেস্তোরাঁ নাগাড়ে খুলে রাখতে কেন্দ্রের নতুন আইনের হাত ধরে এক গোছা সম্ভাবনার দরজা চিচিং-ফাঁক হওয়ারও গন্ধ পাচ্ছে কলকাতা। কিন্তু যাদের হাত ধরে নাগরিক-জীবনের এই নতুন দিক খুলবে, তাঁরা কত দূর প্রস্তুত? সেই প্রশ্নটাও মাথা চাড়া দিচ্ছে।
কারণ অনেকটাই নির্ভর করছে রাজ্যের উপরে। দোকানপাট কতক্ষণ খোলা থাকবে, কর্মীদের কাজের সময় বা ছুটিছাটা কেমন হবে— সব ঠিক করা রাজ্যের এক্তিয়ারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও কিছু প্রশ্ন— রাস্তায় বাস-অটো-ট্যাক্সির কতটা দেখা মিলবে? রাত-শহরে অবাধে চলাফেরার নিরাপত্তার দিকটাই বা কত দূর খেয়াল রাখা হবে? প্রয়োজন থেকে উদ্যাপনের দাবি মেটাতে কত দূর সফল হবে কলকাতার এই সম্ভাব্য ‘নৈশ-জীবন’? নানা মহলে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
বাস্তবিক, উন্নত দুনিয়ার অধিকাংশ বড় শহরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অনেক বিপণি রাতভর খোলা থাকে। এখানেও তেমনটা হলে অফিস-ফেরত চুল ছিঁড়তে হবে না জরুরি দরকারের চাল-ডাল-আটা-ফল কেনার দোকান খুঁজতে। তা সে যত রাতই হোক। রাত বারোটায় বন্ধু বাড়ি এলেও বাজারে তৈরি-খাবার মিলবে। আলো ফুটতে চলা ভোর চারটেয় হাতের নাগালে থাকবে আইসক্রিম। মধ্যরাতেও হুট করে ঢুকে পড়া যাবে রেস্তোরাঁয়।
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী সুজাতা চক্রবর্তী, বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী রমিত সেন থেকে শুরু করে অ্যানিমেশন শিল্পী হিয়া দাস— সকলেই বলছেন, শপিং মল বা দোকানপাট খোলা থাকার সময় বাড়লে সুবিধামতো সময়ে কেনাকাটা করা যাবে। সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘সেক্টর ফাইভে অফিস ছুটির পরে দোকানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ঝাঁপ বন্ধের টেনশন আর থাকবে না। সুতরাং শুরুতে একেবারে ২৪ ঘণ্টা খোলা না থাকলেও, অন্তত সময় কিছুটা বাড়ুক।’’ রমিত-হিয়ার মতো নতুন প্রজন্মের আবার প্রশ্ন, কোনও দিন দেরিতে কাজ শেষ হলে কাছের জিমে গা ঘামানোর রুটিনে কেন বারোটা বাজবে? কিংবা রেস্তোরাঁ-কফিশপের ‘গেট টুগেদার’ শুধু ছুটির দিন বা সপ্তাহান্তের অপেক্ষাতেই বা পড়ে থাকবে কেন?
ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই জানেন, এই ইচ্ছে-উড়ানকে টেনে ধরতেই পা বাড়িয়ে যত প্রশ্নচিহ্নের আঁকশি! আশঙ্কা, রাতবিরেতে রাস্তায় নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ আছে তো! সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, কলকাতা পুলিশে কর্মী সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। এক-এক দিনে রাস্তায় নামেন তার অর্ধেক। তার ছ’হাজার আবার দিনের বেলা ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে। ফলে এত কম পুলিশ দিয়ে রাতে গোটা শহর নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা শক্ত বলে অনেকেরই অভিমত। তবে রাতভর কত দোকানপাট খোলা থাকবে, কত লোক যাতায়াত করবেন— তার ভিত্তিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছকে ফেলার কথা ভাবছে পুলিশ। যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকারের কথায়, ‘‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।’’
‘‘রাত-শহরে নিত্যযাত্রীদের জন্য বাস-ট্যাক্সি-অটোও পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিক হবে,’’ বলছেন পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কিছু বছর আগে বাম আমলে পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর জমানায় শহরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে কিছু ক্ষণ অন্তর নৈশ বাস-পরিষেবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। আজকের কলকাতায় হাওড়া স্টেশনে রাতের বাসের দেখা মেলে। উবের, ওলা-র মতো অ্যাপ চালিত ট্যাক্সির দৌলতে আমনাগরিকের একাংশের চিন্তা খানিকটা দূর হয়েছে। তবে ওই ট্যাক্সির খরচ যাঁদের পড়তায় পোষাবে না, তাঁদের অবস্থা রাত-শহরে এখনও বেশ অসহায়। বিক্রেতাদের দাবি, রাতে গণ পরিবহণ (বাস, মেট্রোরেল, অটো, ট্যাক্সি ইত্যাদি) যত বাড়বে, যত আঁটোসাটো হবে নিরাপত্তা, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে কেনাকাটা করতেও মানুষ ততই স্বচ্ছন্দ হবেন।
রাতের শহর সচল রাখার পরিকাঠামো থাকলে নাগরিক-জীবনের এই বদল মেনে নিতে দ্বিধা করছেন না বিভিন্ন সংগঠনের শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও। শাসক দল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের প্রবীণ নেতা তথা মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় রাত-শহরের আইনশৃঙ্খলা, পরিবহণ ব্যবস্থার উপরে জোর দিচ্ছেন। শহর ঘিরে নয়া পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাতে তৈরি সিটু নেতা অনাদি সাহু বা কংগ্রেসের আইএনটিইউসি রাজ্য সভাপতি রমেন পাণ্ডেও। দু’জনেই বলছেন, সময়ের সঙ্গে জীবনযাত্রা পাল্টাচ্ছে। বদলাচ্ছে চাহিদাও। কর্মীদের শিফ্ট ভাগ করে রাতের ডিউটি দেওয়াই যায়। তাতে আরও বেশি লোকের কর্মসংস্থানও হবে।
কিন্তু মধ্যরাতে যথেষ্ট সংখ্যক ক্রেতা থাকবেন কি না, তা নিয়ে একটা হাল্কা সংশয়ও রয়েছে। বিক্রেতাদের একাংশ মনে করেন, এমন নয় যে সর্বত্র শুরু থেকেই রাতে ভিড় হবে রমরমিয়ে। কিন্তু শহরের কিছু কিছু অঞ্চলে রাতভর দোকান-রেস্তোরাঁ খুলে রাখার রসদ এখনই মজুত বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁদের মতে, কোথাও হয়তো রোজই রাতভর দোকান খুলে রাখার মতো ক্রেতা মজুত। কোথাও হয়তো ভিড় পালা-পার্বণে। কোথাও সারা রাতের বদলে হয়তো শুরুতে কয়েক ঘণ্টা বেশি খোলা রাখা হল বিপণির দরজা। তাঁদের মতে, ক্যাশবাক্সের ঝনঝনানি বুঝে সময়ের বিষয়টা ঠিক করতে সমস্যা হবে না। কিন্তু শুরুটা অন্তত হওয়া জরুরি।
সেই কারণে সময়সীমা বাড়াতে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অ্যাক্রোপলিস মল নির্মাতা সুশীল মোহতার দাবি, ‘‘বিশ্বমানে উঠে আসতে যে কোনও শহরেই ২৪ ঘণ্টার পরিষেবা থাকা জরুরি। তা চালু হলে কলকাতার ভাবমূর্তি বদলে যাবে।’’ ফোরাম মলের কর্তা উজ্জ্বলের (পদবি ব্যবহার করেন না) মতেও এই বদল জরুরি। উল্লেখ্য, সাত বছর আগেই রাজ্যের কাছে রাত ১২টা পর্যন্ত বিপণি খুলে রাখার অনুমতি চেয়েছিল ফোরাম। তখন তা মেলেনি।
ব্যবসায়িক হিসেব-নিকেশ কষার পরে ২৪ ঘণ্টা দরজা খোলা রাখার রাস্তায় পা বাড়াতে চায় শপার্স স্টপ, বিগ বাজারের মতো ব্র্যান্ডও। রাতে শহরের সর্বত্র সব বিপণিতে চাহিদা এক রকম হওয়া অসম্ভব, তা মেনে নিয়েই রিটেলার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার প্রধান কুমার রাজাগোপালন বলছেন, ‘‘চাহিদা বুঝে সময়সীমা ঠিক করবেন বিপণির মালিক। সরকার তা বেঁধে না দিলেই ব্যবসায়ীর সুবিধা।’’
খুচরো ব্যবসায়ীদের যুক্তি, দোকান খুলে রাখার সময়সীমা বাড়লে এক দিকে যেমন বিক্রিবাটা বাড়বে, তেমনই বাড়বে ব্যবসা চালানোর খরচ। কারণ, দোকান বেশি সময় খুলে রাখতে প্রয়োজন বাড়তি কর্মী। তাই বেতন বাবদ বেশি টাকা গুনতে হবে। সঙ্গে বাড়বে বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা ইত্যাদি সংক্রান্ত খরচ। তাই আগেভাগে সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসেব না কষলে লাভের গুড় খেয়ে যাবে লাফ দিয়ে বাড়া খরচই। শপার্স স্টপের প্রধান গোবিন্দ শ্রীখণ্ডে জানান, হিসেব কষে তবেই দোকান খোলা রাখার সময়সীমা ঠিক হবে। একই মত কেএফসি কর্তৃপক্ষেরও। বিগ বাজারের এক মুখপাত্র জানান, তাঁরা বাড়তি সময় বিপণি খুলে রাখবেন এলাকা অনুযায়ী ক্রেতার আনাগোনা বুঝে।
রেস্তোরাঁ মালিকদের চিন্তাটা অন্য জায়গায়। রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে মদ বিক্রির নিয়ম নেই। উৎসবের দিনে সেই নিয়মে ছাড় মেলে। তখন টাকার বিনিময়ে সেই মদ বেচার লাইসেন্স নিতে হয় রেস্তোরাঁগুলিকে। পূর্ব ভারতে হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা সুরেশ পোদ্দার বলেন, ‘‘বেশি রাতে শুধু খাবার খেতে কম ক্রেতাই আসেন। মদের চাহিদা বেশি। তাই বাড়তি সময় রেস্তোরাঁ খোলা রাখতে মদ পরিবেশন করতেই হবে। কিন্তু লাইসেন্স নিয়ে ওই ব্যবসা লাভজনক হওয়া শক্ত। কারণ, উৎসবের দিনের ভিড় তো আর রোজ হবে না।’’
এ রাজ্যে দিন-রাতের দোকানের দাবি উঠেছিল ২০০০ সালেই। বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ তো মূলত পরিষেবা ও অসংগঠিত শিল্প নির্ভর। সেখানে কাজ ২৪ ঘণ্টার হলে দোকানবাজার দিন-রাত খোলা থাকবে না কেন? তখন এই প্রস্তাবে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছিল পূর্বতন বাম সরকার। বিস্তর আলোচনা হয়েছিল বিভিন্ন বণিকসভাতেও। কিন্তু পরে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
১৬ বছর পেরিয়ে কেন্দ্রের নতুন আইনের হাত ধরে ফের সবুজ হয়ে উঠেছে সেই সম্ভাবনা। সমস্যা এখনও আছে। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই মনে করে, রাতের বিকিকিনি চালু হলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। পুজো-পার্বণে রাস্তায় মানুষের সংখ্যা বাড়লে নিরাপত্তা এমনিই বাড়ে। ইডেনে আইপিএল থাকলে বেশি রাতেও ধর্মতলায় ভিড় করে ট্যাক্সি। নগদ সঙ্গে রাখা ঝুঁকির বলে রাতে মার্কিন মুলুকের বহু শহরেই লেনদেন হয় কার্ডে। খদ্দের আসে বলেই কলকাতার অনেক মোড়ে বেশি রাতেও খোলা থাকে চায়ের দোকান। সেই মতো এ ক্ষেত্রেও বাজারের নিজস্ব নিয়মেই সমাধান সামনে আসবে বলে বিক্রেতাদের ধারণা।
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তবেই রোজ ২৪ ঘণ্টা দোকান খোলা রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন তাই মাঝরাতে আইসক্রিমের অপেক্ষা।