‘বাবু, আমি কি অল্প আহত নাকি বেশি? একটু বলবেন?’

গোটা মাথাটা জুড়ে ব্যান্ডেজ। ন্যূব্জ, শীর্ণ শরীর আরও ন্যূব্জ হয়েছে দু’দিনে। হাতে, পায়ে, কোমরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কালশিটের দাগ। মাথা থেকে এখনও মাঝেমধ্যেই রক্তপাত হচ্ছে। সাদা ব্যান্ডেজে চাপ চাপ রক্তের দাগ। সরু এক ফালি ঘরটার সিড়ির সামনে বেরিয়ে এসেছেন ঠিকই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে গুপি সাউয়ের।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ১২:২০
Share:

উড়ালপুল দুর্ঘটনায় আহত রিক্সাচালক গুপি সাউ। —নিজস্ব চিত্র।

গোটা মাথাটা জুড়ে ব্যান্ডেজ। ন্যূব্জ, শীর্ণ শরীর আরও ন্যূব্জ হয়েছে দু’দিনে। হাতে, পায়ে, কোমরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কালশিটের দাগ। মাথা থেকে এখনও মাঝেমধ্যেই রক্তপাত হচ্ছে। সাদা ব্যান্ডেজে চাপ চাপ রক্তের দাগ। সরু এক ফালি ঘরটার সিড়ির সামনে বেরিয়ে এসেছেন ঠিকই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে গুপি সাউয়ের।

Advertisement

পেশায় রিক্সাচালক গুপি। আপাতত অবশ্য পেশা নেই। সবেধন নীলমণি যে টানা রিক্সাটা ছিল, সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবার। গণেশ টকিজের মোড়ে রিক্সা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে ছিলেন গুপি। আচমকা ধসে পড়া উড়ালপুল তাঁর রিক্সাটাকে ছত্রখান তো করেই দিয়েছে। কংক্রিটের চাঙড়ের আঘাতে ফেটেছে মাথা। চোট সারা শরীরে। তার পর থেকেই জোড়াবাগানের সঙ্কীর্ণ গলিতে সরু একফালি ঘরটাতে সারা দিন কাটছে গুপির।

ক্ষীণ স্বরে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন গুপি সাউ। বললেন, ‘‘রাস্তার ধারে রিক্সাটা রেখে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম মড় মড় করে আওয়াজ হচ্ছে মাথার উপর। উপরে তাকিয়ে দেখি লোহা বেঁকে যাচ্ছে। কোনও দিকে না দেখে ফুটপাথের দিকে ঝাঁপ দিলাম। একটা দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ব বাবছিলাম। কিন্তু হল না। তার মধ্যেই ধসে পড়ল ব্রিজটা। কী একটা ছিটকে এসে খুব জোরে মাথায় পড়ল। পড়ে গেলাম। তার পর আর মনে নেই।’’ দুর্ঘটনার পর স্থানীয় লোকজনই হাসপাতালে পৌঁছে দেন গুপিকে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গুপিকে। মাথা থেকে মাঝেমধ্যেই রক্তপাত হচ্ছে। শরীরে বিভিন্ন অংশ ব্যাথা। কোথাও হাড় ভেঙেছে কি না, কোথাও চিড় ধরেছে কি না, সে সব আর পরীক্ষা করে দেখা হয়নি হাসপাতালে।

Advertisement

এক ফালি ঘরের সামনে গুপি।

আরও পড়ুন:

কলকাতায় নেমেই পোস্তায় রাহুল, মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস

ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে বাড়ি গুপির। কলকাতায় তিনি রিক্সা টানতেন। সেই উপার্জনে হাজারিবাগে সংসার চলত। এখন সেই রিক্সাটাও আর নেই। সারা দিন রিক্সা টেনে, রাতে জোড়াবাগানের ঘুপচি গলিতে স্যাঁতসেঁতে একটা সরু ফালির মতো যে ঘরে ঘুমোতে আসেন গুপি, সেই ফালি ঘরটাতেই এখন সারা দিন কাটছে। এক কোনায় হাঁড়ি-কড়া-বাসন উল্টে রাখা। দরজার সামনে মাথা রেখে ভিতর দিকে পা মেলে একটা কম্বলের উপর শুয়ে থাকছেন গুপি। দুর্ঘটনার পর এক তৃণমূল নেতা দেখতে এসেছিলেন গুপিকে। বলে গিয়েছেন, চিন্তা নেই ক্ষতিপূরণ মিলে যাবে। অল্প আহতদের এক লক্ষ টাকা আর বেশি আহতদের দু’লক্ষ টাকা দেবে সরকার। কিন্তু গুপি সাউ-এর ক্ষতি তো শুধু আহত হওয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর পেট চলার উপায়টাও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু দিন কাজ করতে পারবেন না। তত দিন সংসারটা কিন্তু টানতেই হবে। নতুন একটা রিক্সাও কিনতে হবে।

অল্প কয়েক মিনিট ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফালি ঘরটায় ঢুকে যাচ্ছিলেন ন্যূব্জ গুপি। কিন্তু ফের পিছন ফিরলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বাবু, একটা কথা বলব? আমি কি অল্প আহত, নাকি বেশি আহত? কত টাকা পেতে পারি একটু বলবেন।’’ কী উত্তর দেবো, ভেবে পাইনি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন