বৃদ্ধাকে খুন করে রাতভর সে ঘরেই দাদার শ্যালিকা

প্রমীলা পাল খুন করত পুরুষের ছদ্মবেশে। তাকে ধরতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল ‘অদ্বিতীয়’র ব্যোমকেশ বক্সীকে।তালতলার বৃদ্ধা আলো মজুমদার খুন হওয়ার দশ দিনের মধ্যেই অন্য এক প্রমীলাকে গারদে পুরল পুলিশ। গিরিশ পার্ক থেকে গ্রেফতার হওয়া ৪০ বছরের ওই মহিলার নাম মৌমিতা বিশনানি। পুরুষের ছদ্মবেশে না থাকলেও তাকে ধরতে কম কসরত করেনি পুলিশ। প্রথমে সন্দেহের তালিকায় নামই ছিল না তার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তালতলা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৮
Share:

নিহত আলো মজুমদার

প্রমীলা পাল খুন করত পুরুষের ছদ্মবেশে। তাকে ধরতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল ‘অদ্বিতীয়’র ব্যোমকেশ বক্সীকে।

Advertisement

তালতলার বৃদ্ধা আলো মজুমদার খুন হওয়ার দশ দিনের মধ্যেই অন্য এক প্রমীলাকে গারদে পুরল পুলিশ। গিরিশ পার্ক থেকে গ্রেফতার হওয়া ৪০ বছরের ওই মহিলার নাম মৌমিতা বিশনানি। পুরুষের ছদ্মবেশে না থাকলেও তাকে ধরতে কম কসরত করেনি পুলিশ। প্রথমে সন্দেহের তালিকায় নামই ছিল না তার।

কলকাতা বা আশপাশে সাম্প্রতিক কালে খুনের ঘটনা কম ঘটেনি। কিন্তু, হিংসা-আক্রোশ না থাকা সত্ত্বেও এক মহিলার দিকে খুনের অভিযোগ ওঠার ঘটনার কথা শোনা যায়নি। তালতলার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, আলোদেবীর আলমারি থেকে সোনার গয়না চুরির সময়ে ধরা পড়ে গিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে তাঁকে খুন করে মৌমিতা। নিশ্চিত হতে বালিশের ঢাকনা খুলে তা পেঁচিয়ে ধরে আলোদেবীর গলাতেও। এর পরে আলোদেবীর নিথর দেহের সঙ্গে অবলীলায় চার ঘণ্টা সময় কাটিয়ে ভোরবেলা গয়না নিয়ে চম্পট দেয় সম্পর্কে আলোদেবীর দাদা মোহনলাল আঢ্যর শ্যালিকা মৌমিতা। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আলোদেবী তালতলার ডক্টরস লেনে মোহনলালের বাড়িতেই থাকতেন।

Advertisement

পুলিশের দাবি, পরদিন সকালে আলোদেবীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তা পৌঁছয় মৌমিতার কানেও। তখন তিনি ভাল মানুষের মতো মুখ করে সান্ত্বনা দিতে চলে আসেন তালতলার ওই বাড়িতেই। পটু অভিনেতার মতো মুখ করে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যান। পুলিশ তাঁকে ডেকে যখন প্রথম বার জেরা করে তখন ভাবলেশহীন মুখে জানিয়ে দেন, তিনি ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনকী পরিবারের অন্যদের দিকে আঙুলও তোলেন মৌমিতা। পুলিশ ধন্দে পড়ে যায়। কারণ, আলোদেবীর মৃতদেহের কানে ও গলায় সোনার গয়না ছিল। যুক্তি ছিল, পেশাদার ডাকাতেরা সোনা নিতে এলে এই গয়না কেন নিয়ে গেল না?

ধৃত মৌমিতা

পুলিশ সূত্রে খবর, মৌমিতা নিজেই কবুল করেছে খুনের কথা। খুন করা হয়েছিল ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। তার দিন দুই আগে মোহনলালের চোখের অপারেশন হয়েছিল। তাঁকে দেখতে ওই দিন সকালে দুই মেয়েকে নিয়ে তালতলায় আসে মৌমিতা। সন্ধ্যা সাতটায় মেয়েদের নিয়ে বেরিয়েও যায়। এস এন ব্যানার্জি রোডের বাসস্টপে পৌঁছে মেয়েদের বাসে তুলে ফিরে আসে মোহনলালের বাড়িতে।

বাড়ির একতলায় একাই থাকতেন আলোদেবী। ছেলে চন্দন চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছেন। ওই বাড়ির দরজা সাধারণত রাত পর্যন্ত খোলাই থাকত। পুলিশ জানিয়েছে, মৌমিতা ফিরে এসে একতলায় আলোদেবীর পাশের ঘরে আলনার কোণে লুকিয়ে পড়ে। আলোদেবী তখন নিজের ঘরেই ছিলেন। রাত ন’টার পরে আলোদেবী রান্না শেষ করে উপরে যেতেই তাঁর ঘরে খাটের নীচে লুকিয়ে পড়ে মৌমিতা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সদর দরজায় তালা মেরে রাত ১১টা নাগাদ নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়েন আলোদেবী। মৌমিতা জানতেন আলমারির চাবি কোথায় থাকে। আলোদেবী ঘুমিয়ে পড়লে সেই চাবি নিয়ে তিনি আলমারি খোলেন। অন্ধকারে হাতড়াতে গিয়ে একটি গয়নার বাক্স নীচে পড়ে যায়। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আলোদেবীর।

তদন্তকারীদের দাবি, জেরার মুখে মৌমিতা জানান, তাঁকে দেখে অবাক হয়ে আলোদেবী বলেন, ‘‘তুই এখানে কেন, এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে যা। না হলে চিৎকার করব।’’ এর পরেই আলোদেবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মৌমিতা। বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরে তাঁর। রাতেই মারা যান আলোদেবী।

কী ভাবে মৌমিতার উপরে সন্দেহ দানা বাঁধে পুলিশের? তদন্তকারী অফিসারেরা জানান, মৃতদেহ উদ্ধারের আগের দিন ওই বাড়িতে বাইরের কারা এসেছিল, তার হদিস করতে গিয়ে মৌমিতা ও তার দুই মেয়ের কথা জানা যায়। এ বার জেরায় মৌমিতার কথায় কিছু অসঙ্গতি মেলে। গত শনিবার তাঁর দুই মেয়েকে জেরা করে জানা যায়, ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের সঙ্গে তালতলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেও আবার সেখানেই ফিরে যান মৌমিতা।

লালবাজারের এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘মৌমিতার দুই মেয়ে জানান, এস এন ব্যানার্জি রোডের বাস স্টপেজে এসে মা তাঁদের বাড়ি চলে যেতে বলেন। জানান, তিনি পরে কাজ শেষ করে বাড়ি যাবেন।’’ এর পরে ফের মৌমিতাকে ডেকে পাঠিয়ে জেরা শুরু হয়। লাগাতার জেরার মুখে রবিবার রাতে ভেঙে পড়েন মৌমিতা। ঘটনার দিন মৌমিতার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনও জানিয়ে দেয়, ৪ ফেব্রুয়ারি সারা রাত তিনি তালতলা এলাকাতেই ছিলেন। অথচ মৌমিতার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল গিরিশ পার্কের বাড়িতে। যে বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে আলোদেবীর আলমারি থেকে খোয়া যাওয়া গয়না।

সোমবার আদালত মৌমিতাকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এ নিয়ে অবশ্য মোহনলাল এ দিন মুখ খুলতে চাননি। মোবাইল ফোনে, বাড়িতে গিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি। আলোদেবীর ছেলে চন্দন এ দিন জানান, মৌমিতাকে বাড়িতে আসতে দেখলেও তাঁর সঙ্গে কোনও দিন কথা হয়নি। তবে আঢ্য পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যদের সঙ্গে যে মৌমিতার সম্পর্ক ভাল ছিল না, সে কথাও জানান চন্দন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন