বাজির ধোঁয়ায় বিষাক্ত বাতাস, শ্বাসকষ্ট বেড়েছে সর্বত্র

রাত দশটায় ভিআইপি রো়ডের উপরে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন চালক। নভেম্বরের গোড়াতেই যেন চাপ ধরে রয়েছে ধোঁয়াশা! রাত বারোটার সিঁথির মোড়। ফাঁকা রাস্তায় দম নিতে গেলে হাঁফ ধরছে। কেউ কেউ খুকখুক করে কাশছেনও। গোটা এলাকার বাতাস যেন ভারী হয়ে গিয়েছে!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৫ ১৯:২০
Share:

রাত দশটায় ভিআইপি রো়ডের উপরে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন চালক। নভেম্বরের গোড়াতেই যেন চাপ ধরে রয়েছে ধোঁয়াশা!

Advertisement

রাত বারোটার সিঁথির মোড়। ফাঁকা রাস্তায় দম নিতে গেলে হাঁফ ধরছে। কেউ কেউ খুকখুক করে কাশছেনও। গোটা এলাকার বাতাস যেন ভারী হয়ে গিয়েছে!

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্যও বলছে, কালীপুজোর সন্ধ্যা পেরোতেই বাতাসে হু-হু করে বাড়ছিল দূষণের মাত্রা। রাত বারোটা পেরনোর আগেই শহরের একাংশে তা উঠে গিয়েছিল সহনমাত্রার ছ’গুণ উপরে! রাত পেরিয়ে ভোর হলেও সেই দূষণের মাত্রা কিন্তু কমেনি। এবং এই দূষণের পিছনে আতসবাজিকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁরা বলছেন, শব্দবাজির দূষণ তো রয়েইছে, তার থেকেও বেশি ক্ষতি করে আতসবাজির ধোঁয়া। একই মত শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসকদের। তাঁরা বলছেন, এই দূষণ থেকে হাঁপানি, শ্বাসনালির রোগ হতে পারে। ফুসফুসে বাসা বাঁধতে পারে ক্যানসারও। ‘‘শব্দবাজির হানা মালুম হয়। কিন্তু আতসবাজির কুফল নীরব ঘাতকের মতো,’’ বলছেন এক চিকিৎসক।

Advertisement

পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, আতসবাজির মধ্যে গন্ধক, লোহাচুর, অ্যালুমিনিয়াম চুর, ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক থাকে। সেগুলি পোড়ানোর ফলে তৈরি হওয়া বিষাক্ত ধোঁয়া এবং ভাসমান ধূলিকণা তৈরি হয়। সেগুলি বাতাসে মিশে যাওয়ার ফলেই দূষণের মাত্রা বাড়ে। যার উদাহরণ হিসেবে মঙ্গলবার কালীপুজোর রাতে শহরে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণকে তুলে ধরছেন পর্ষদের বিজ্ঞানীদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, প্রতি দিন বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার সর্বাধিক স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০০। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে বিটি রোডে স্বয়ংক্রিয় দূষণমাপক যন্ত্রে সন্ধ্যায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ ছিল ১২৫। রাত ৯টায় ৩৩৪ এবং রাত ১২টায় ৬৮১।

পরিবেশবিদদের একাংশ বলছেন, রংমশাল, ম্যাগনেসিয়াম তারের মতো বাজি থেকে যে ঘন ধোঁয়া তৈরি হয়, তার ভিতরে ভাসমান সুক্ষ্ম ধূলিকণা থাকে। সেই সুক্ষ্ম ধূলিকণাও শ্বাসরোগের অন্যতম কারণ। পরিবেশবিদদের একাংশ বলছেন, কালীপুজোর পর বাতাসে সুক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণও বেড়ে যায়।

পরিবেশবিদ ও চিকিৎসকদের এই কথা কতটা সত্যি, কালীপুজোর রাতে তা টের পেয়েছেন অনেকেই। লেক গার্ডেন্সের বাসিন্দা সুশান্ত ঘোষ মেয়ের সঙ্গে বাজি পোড়াচ্ছিলেন। রংমশালের ধোঁয়ায় তাঁর কাশি শুরু হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গলা ধরে গিয়েছিল তাঁর। রানীকুঠির গৌরাঙ্গ দাসও পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে বাজি পোড়াতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ বোধ করছিলেন। নিউ ব্যারাকপুরের এক বহুতলের ছাদে বাজি পোড়াচ্ছিলেন বাসিন্দারা। তুবড়ি, রংমশালের ধোঁয়ায় ছাদ ঢেকে যাওয়ায় নাকে রুমাল বেঁধেছিলেন অনেকে।

বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বাজির ধোঁয়ায় প্রচুর পরিমাণে সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড থাকে। এই সব বিষাক্ত ধোঁয়া ফুসফুসে চলে গেলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। শুকনো কাশিও হতে পারে। হাঁপানি রোগীদের অবস্থা প্রাণান্তকর হয়ে উঠতে পারে। বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘এই ধরনের ধোঁয়া থেকে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষতির আশঙ্কা সব থেকে বেশি। সুস্থ লোকেরাও এই ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। কালীপুজো পেরোতেই এই ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।’’ কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসুর মতে, ‘‘হৃদরোগ রয়েছে এমন রোগীর দেহে আতসবাজির বিষাক্ত ধোঁয়া ঢুকলে তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।’’ কলকাতার চিকিৎসকদের একাংশের অভিজ্ঞতা বলছে, বুধবার সকাল থেকেই শ্বাসকষ্ট, কাশি নিয়ে রোগীরা ফোন করছেন। হাঁপানির রোগীদের কষ্ট বেড়ে গিয়েছে।

বাতাসের এই দূষণের পিছনে আবহাওয়ার মতিগতিকেও দায়ী করছেন আবহবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, শীত যত এগিয়ে আসছে, ততই বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তর ঠান্ডা হচ্ছে। এর ফলে বাতাসের ধূলিকণা নীচের স্তরে জমাট বাঁধে। বাজি থেকে বেরনো ধোঁয়া ও ধূলিকণাও সেই কারণে বাতাসের নীচের স্তরে জমাট বেঁধে থাকছে। এ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় বাতাস থেকে ধূলিকণা সহজে দূর হয় না। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ‘‘এই দূষণ বহু দিন ধরে থাকে। তা একটা বড় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এর ক্ষতি শব্দবাজির থেকেও বেশি।’’

পর্ষদকর্তারা বলছেন, শব্দবাজির দাপট অনেক কমেছে। সচেতনতাও অনেক বেড়েছে। এ বার আতসবাজি নিয়েও সচেতনতা দরকার। তা না হলে আলোর উৎসবের এই দূষণ কমবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন