সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বন্ধু’র অত্যাচারে দুর্বিষহ জীবন।
বহু দিনের সহকর্মীর আচরণ যে আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে, তা লক্ষ করেছিলেন সল্টলেকের বাসিন্দা, সরকারি চাকুরে পারমিতা রায়চৌধুরী (নাম পরিবর্তিত)। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর পোস্টে-ছবিতে অপ্রয়োজনীয় কথা চালাতে চাইছেন ওই সহকর্মী, তা-ও খেয়াল করেছিলেন। কিন্তু প্রথমে ততটা গা করেননি। ক্রমশ বন্ধুবান্ধবদের নজরেও পড়তে থাকে সহকর্মীর কীর্তিকলাপ। আর চুপ থাকেননি চল্লিশোর্ধ্ব পারমিতা। প্রায় দু’বছর ধরে চলা ওই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও ফোনে ব্লক করতে বাধ্য হন ওই ‘বন্ধু’কে।
ফেসবুকেই কর্পোরেট চাকুরে সুমনা দাশগুপ্তের (নাম পরিবর্তিত) আলাপ হয় এক তবলাবাদকের সঙ্গে। আস্তে আস্তে শুরু হয় মেসেজ-হোয়াটস্অ্যাপে জোরাজুরি, হুমকি, অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা। শান্তি হারিয়ে মধ্য চল্লিশের সুমনাও এখন দুষছেন সোশ্যাল মিডিয়াকেই।
ফেসবুক-টুইটারে কারা কী সমালোচনা করছেন, বিরোধীদের প্রচারে কতটা সাড়া মিলছে— তার আঁচ পেতে নেট-দুনিয়ায় নজরদারি করেই থাকে রাষ্ট্র। এ দেশে এ নিয়ে ‘সোশ্যাল মিডিয়া হাব’ তৈরির কাজও শুরু করেছিল কেন্দ্র। নেট-নজরদারিতে পিছিয়ে নেই রাজ্যও। তবে শুধু প্রশাসনই নয়, সতর্ক না থাকলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারির শিকার হতে হচ্ছে ব্যক্তিগত স্তরেও। অফিসের সহকর্মী থেকে প্রাক্তন বন্ধু বা বান্ধবী, অচেনা ফেসবুক-বন্ধু থেকে অনুসন্ধিৎসু আত্মীয়— মেঘনাদের মতো ‘লুকিয়ে’ নজরদারের ভূমিকায় থাকতে পারেন এঁরা সকলেই। তাঁদের হাতিয়ার হয় ফেসবুক- টুইটার- ইনস্টাগ্রামে ‘শিকারে’র দেওয়া ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য। ‘শিকার’ কখন কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে মিশছেন, কার সঙ্গে অনলাইনে কথা বলতে রাত জাগছেন— ফেসবুক-হোয়াটস্অ্যাপের যুগে অধরা নয় সেই তথ্য! প্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করে ‘শিকারে’র বন্ধুতালিকাতেও অবাধ যাতায়াত তাঁদের। কখনও আবার ‘শিকারে’র নামেই ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে তাঁর সম্মানহানির চেষ্টাও করা হয়।
কেন এই মনোভাব? মনোবিদ মোহিত রণদীপ বলছেন, ‘‘ক্ষমতা ও অধিকারবোধ থেকেই এই মানসিকতা তৈরি হয়। কখনও সন্দেহ, কখনও অভিসন্ধি, প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে করা— এগুলিই কারণ।’’ অনেক সময়ে মানসিক অসুখ থেকেও নেট-দুনিয়ায় অনেকে নজরদারি চালান। কেন? মোহিতের যুক্তি, ‘‘সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরেও অনেকে তা মানতে পারেন না। প্রাক্তনের উপরে নজরদারি শুরু করেন। ভুল করছেন বুঝেও থামাতে পারেন না নিজেকে। এঁদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।’’
পারমিতা-সুমনার মতো অনেকে আবার প্রথমে বুঝতেই পারেন না যে কী ভাবে চোখে-চোখে রাখা হচ্ছে তাঁকে। অনেকে বুঝেও ব্যবস্থা নিতে সাহস পান না। পারমিতার আক্ষেপ, ‘‘আমার বয়সে এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত অস্বস্তিকর ছিল। কিন্তু অফিসে অ্যান্টি হ্যারাসমেন্ট সেলে অভিযোগ জানাতে গেলে আমার চরিত্র নিয়েও কথা শুনতে হতে পারত। তাই অসম্মানের ভয়ে সে দিকে যাইনি।’’
তবে উপায়? স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিংয়ের কর্ণধার এবং সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘আজকাল চাকরির দরখাস্ত করলেও ফেসবুকে নজরদারি চালায় সংস্থা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোও আপনার গতিবিধির উপরে নজর রাখে। এ থেকে বাঁচতে অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি সেটিং ঠিক করতে হবে। সেটাই একমাত্র সমাধান।’’ লালবাজার সাইবার সেলের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, নজরদারের নজর এড়াতে ফেসবুকে অচেনা ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ এ়ড়িয়ে চলা উচিত। ব্যক্তিগত তথ্য অথবা ব্যক্তিগত মতামত কতটা সর্বসমক্ষে আনবেন, তা নিয়েও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। সাইবার সেল সূত্রে জানানো হয়েছে, নজরদারির শিকার হলে প্রথমেই ইউআরএল-সহ নজরদারের অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশট নিয়ে সাইবার সেলের দ্বারস্থ হতে হবে। অভিযোগের গুরুত্ব বিচার করে ৬৬ডি, ৬৬ই, ৬৭এ বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্তকে সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।