বাজার ঘুরল আনন্দবাজার

ওয়ান-শটার, পিস্তল, দানা সব রেডি

কালো প্লাস্টিকের মোড়ক খুলতেই বেরোল চকচকে কালো সেভেন এম এম পিস্তল। সেটা আমার হাতে দিয়ে বলা হল, ‘‘এই নিন, যা চাইছিলেন। এমনিতে আমরা কুড়ি হাজারের উপরে দাম নিই। তবে আপনার জন্য আঠেরো। কার্তুজ এক-একটা সাড়ে চারশো টাকা পড়বে। দু’টো ম্যাগাজিন দিয়ে দিচ্ছি। ম্যাগাজিনে এক ডজন করে গুলি।’’

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৭
Share:

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

কালো প্লাস্টিকের মোড়ক খুলতেই বেরোল চকচকে কালো সেভেন এম এম পিস্তল। সেটা আমার হাতে দিয়ে বলা হল, ‘‘এই নিন, যা চাইছিলেন। এমনিতে আমরা কুড়ি হাজারের উপরে দাম নিই। তবে আপনার জন্য আঠেরো। কার্তুজ এক-একটা সাড়ে চারশো টাকা পড়বে। দু’টো ম্যাগাজিন দিয়ে দিচ্ছি। ম্যাগাজিনে এক ডজন করে গুলি।’’

Advertisement

পিস্তল হাতে নিয়ে দেখা গেল, ম্যাগাজিন নেই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতা বললেন, ‘‘আনাড়ি হাত তো, তাই ম্যাগাজিন খুলে নিয়েছি। চিন্তা নেই, আগে হাতেগরম পরখ করে দেখে নেবেন কেমন চলে, তার পরে দাম দেবেন। আসুন।’’

কংক্রিটের চাতালে এতক্ষণ বসেছিলেন আর পাঁচ জনের সঙ্গে। এ বার উঠে দাঁড়ালেন ওই ব্যক্তি। সঙ্গে বাকিরাও। ওঁদের পিছু পিছু প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটা কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে। একটা ছোট পুকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ওই পিস্তল বিক্রেতা। কার্তুজ ভরে ম্যাগাজিন ঢোকানো হল পিস্তলের বাটে। তার পরে হাতে দিয়ে বলেন, ‘‘পিস্তলের নল নিচু করে পুকুরের জলে তাক করে চালান।’’ একটু ইতস্তত করতে দেখেই তাঁর আশ্বাস, ‘‘চালান, চালান। কোনও অসুবিধা হবে না। মাখনের মতো নরম ট্রিগার। আপনাদের মতো আনাড়িদের কথা মাথায় রেখেই তো মেশিন তৈরি করতে হয়।’’

Advertisement

মাখনের মতো না হলেও ট্রিগার টিপতে বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে হল না। দু’বার চাপ আর ফটফট করে আওয়াজ। পুকুরের জল ছিটকে উঠল। ফের হাসেন বিক্রেতা, ‘‘কী বলেছিলাম?’’

এ বার ফেরার জন্য আবার হাঁটা শুরু। বিক্রেতার এক সঙ্গী বলেন, ‘‘ব্র্যান্ডেড জিনিস কিনতে গেলে একগাদা দাম। এই সব দেশি মেশিন এখন বিদেশি জিনিসের বাবা।’’ আর এক জনের কথায়, ‘‘মুঙ্গেরে যাওয়ারও দরকার নেই। ওখান থেকে আনতে অনেক ঝামেলা হচ্ছিল। দামও আপনার বেশি পড়ত। আমাদের রিস্ক বেশি থাকত বলে। এখন ওদের কারিগরেরা এখানে এসে তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে। তাই, দামও কম পড়ছে। বাড়ির কাছে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন।’’

কলকাতা বন্দর লাগোয়া দক্ষিণ শহরতলির এক তল্লাট। রাতের অন্ধকারে কানে আসছে শুধু সেলাই মেশিন চলার মতো ঘরঘরে আওয়াজ। কিন্তু এত সংখ্যক ওস্তাগর কেন কাজ করছেন এখানে? যা কি না সেভেন এম এম, নাইন এম এম, ওয়ান শটার, বড় নলওয়ালা বন্দুক— হরেক কিসিমের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির ঠেক! বন্দুক শিল্পের ছোটখাটো তালুক বলা যেতে পারে। ব্যবসা যাঁরা চালান, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু এক ‘দাদা’, যিনি তাঁদের বিশ্বাস ও আস্থাভাজন। নিয়মিত খদ্দের বলে ভোটের সময়ে তাঁর কাছ থেকে প্রচুর অর্ডার মিলছে।

তবে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেকে দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দা ও রাজারহাট এলাকায় ইট-বালি-স্টোনচিপস সরবরাহ করার ছোটখাটো সিন্ডিকেট চালাই বলে জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ভোটের আগে সিন্ডিকেটের মধ্যেই গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। আত্মরক্ষার কারণে পিস্তল লাগবে। আর আমার এক ছায়াসঙ্গীর জন্য একটা ওয়ান-শটার কিনতে চাই।

এই সব তথ্য সেই ‘দাদা’ মারফত দেওয়ার চার দিন পরে ও দিক থেকে জানানো হল, যেতে হবে সন্ধ্যার পরে। পুরো টাকা নগদে নিয়ে যেতে হবে। শর্ত আরও। নিজস্ব কোনও গাড়ি বা মোটরসাইকেলে চড়ে যাওয়া যাবে না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। তার পরে দায়িত্ব ওদের। আর সঙ্গে থাকবে কেবল ল্যাপটপের একটা খালি ব্যাগ। ‘যন্তর’ কিনে ওতেই ভরে নিতে হবে।

জঙ্গলমহলে এক সময়ে মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজির সাক্ষাৎকার নিতে সাংবাদিকদের পৌঁছতে হত মাওবাদীদের গোপন ডেরার বেশ খানিকটা আগে কোথাও। এখানেও অনেকটা সে রকম ব্যাপার।

রাত আটটা নাগাদ সেই দাদার সঙ্গে পৌঁছলাম ওদের বলে দেওয়া এক জায়গায়। দু’জন এলেন দু’টো মোটরসাইকেল নিয়ে। ওদের পাঠানো দু’টো মোটরবাইকের পিছনে বসে প্রায় তিন কিলোমিটার উজিয়ে পৌঁছনো গেল এক ডেরায়। সেখানেই প্রথম কানে এল সেলাই মেশিনের সেই একটানা ঘরঘরে শব্দ। তার পরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটা। থামার পরে দেখা গেল, কংক্রিটের চাতালে বসে ছ’জন। গোল হয়ে বসে মাদুর পেতে তাস খেলছেন। ‘দাদা’-কে দেখেই তাঁরা তাস খেলা বন্ধ করে কুশল বিনিময় করলেন। স্বাগত জানালেন পরিচয় না জানা সাংবাদিককেও। বেশ বোঝা গেল, সঙ্গে যাওয়া দাদাই এখানে প্রবেশের পাসপোর্ট-ভিসা। কলকাতায় প্রথম দফার ভোট ২১ এপ্রিল। তার আগে ক’টা কী জিনিস চাই, তার অর্ডার দিলেন দাদা। বলে দিলেন বুলেটের পরিমাণও।

এ বার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে এক ব্যক্তি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক জনকে ইশারা করলেন। ওই আস্তানায় নবাগতের সঙ্গে তাঁদের আরও কিছু বাক্য বিনিময়ের এক ফাঁকেই বছর উনিশ-কুড়ির দুই তরুণ দিয়ে গিয়েছিলেন কালো প্লাস্টিকের সেই মোড়ক। যার ভিতরে ছিল সেভেন এম এম পিস্তল।

পুকুরের জলে সেই পিস্তল থেকে দু’রাউন্ড গুলি চালিয়ে সব ঠিকঠাক আছে বলে দেখে নেওয়ার পরে ফের ওই কংক্রিটের চাতালে ফিরে আসা। তখন দেখা গেল, মাদুরে তাসের সঙ্গে রাখা কয়েকটি ওয়ান শটার। একটি হাতে তুলে দেখিয়ে এক জন বললেন, ‘‘এটার জন্য তিন হাজার লাগবে। এর জন্য থ্রি নট থ্রি দানা। পাঁচশো টাকা করে লাগবে।’’

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। তখনও চাতালের চারপাশ থেকে সেলাই মেশিনের সেই ঘরঘরে আওয়াজ। রাত বাড়তে আরও যেন বেড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় তৈরি হয় এগুলো? শুধু তো সেলাই মেশিনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে! মুচকি হেসে এক জন বললেন, ‘‘সেলাই মেশিন আর বন্দুক তৈরির লেদ মেশিনের আওয়াজ কিন্তু প্রায় একই রকম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন