এই শহর এখন বড় অচেনা লাগে

কলকাতা। আমার শহর। তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক কথাই ভিড় করে আসছে। এলোমেলো ভাবে অবশ্যই। ওই ভিড়ের যা ধর্ম আর কী! বড়-ছোট-প্রধান-অপ্রধান আলাদা ভাবে বোঝা যায় না। আমার জন্ম দক্ষিণ কলকাতায়। খিদিরপুরে মামাবাড়িতে বেড়ে ওঠা। সময়টা ষাটের দশকের মাঝামাঝি। যে সব জায়গাকে এখন দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র বলে চিনি, সে সব জায়গা— অন্তত তার বেশির ভাগ জায়গাই তখনও প্রায় জনবিরল।

Advertisement

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share:

কলকাতা। আমার শহর। তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক কথাই ভিড় করে আসছে। এলোমেলো ভাবে অবশ্যই। ওই ভিড়ের যা ধর্ম আর কী! বড়-ছোট-প্রধান-অপ্রধান আলাদা ভাবে বোঝা যায় না। আমার জন্ম দক্ষিণ কলকাতায়। খিদিরপুরে মামাবাড়িতে বেড়ে ওঠা। সময়টা ষাটের দশকের মাঝামাঝি। যে সব জায়গাকে এখন দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র বলে চিনি, সে সব জায়গা— অন্তত তার বেশির ভাগ জায়গাই তখনও প্রায় জনবিরল। অথচ ডক-এর দৌলতে খিদিরপুর বেশ জমকালো, ব্যস্ত। বহু আগে থেকেই। অনেকটা উত্তর কলকাতার মতো বনেদি। বর্ণবিন্দুদের সঙ্গে খানদানি মুসলমান এবং অসংখ্য খ্রিস্টান পরিবারের আশ্চর্য সহাবস্থানে খিদিরপুরের তখন এক মেট্রোপলিটন আমেজ। এখনও যে সেটা একেবারেই নেই তেমনটা নয়। এহেন পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে ধর্মের একটা বড় মানে ছোট থেকেই বুঝতে শিখেছি। মনে পড়ে দুর্গাপুজোর আনন্দের সঙ্গে বড়দিন বা ঈদের আনন্দও আমরা সমান তালে উপভোগ করেছি। পশ্চিমপল্লির মাঠের ঠিক পাশেই আমাদের বাড়িটা। তাই খেলাধুলোর সঙ্গে সেই ছোট থেকেই নাড়ির টান। আমাদের ক্লাব-ব্যান্ডের নাম ছিল ‘তূর্যস’, এক সময় বেশ নাম করেছিল। পশ্চিমপল্লির মাঠে তো বটেই, সেন্ট টমাস স্কুলের মাঠেও প্রচুর ফুটবল, ক্রিকেট, ছোট রাবারের বল দিয়ে খেলেছি। ভাগ্যিস আজকের দিনে জন্মাইনি। বইয়ের ভারে ঝুঁকে পড়া বাচ্চাগুলোকে দেখলে নিজেদের সত্যিই খুব ভাগ্যবান মনে হয়।

Advertisement

আমি বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের ছাত্র। ১৯৭৩ সাল নাগাদ ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হই। তখন মর্নিং স্কুল। রেখাদি, ছায়াদিদের কথা এখনও মনে আছে। স্কুল থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। আমি আজকে যা কিংবা যতটা, তাতে আমার স্কুলের অবদান অনেক। শুধু মাত্র পুঁথি পড়া পণ্ডিত হওয়ার শিক্ষা আমরা কোনও দিনও শৈলেশবাবু, সত্যেনবাবুদের কাছ থেকে পাইনি। বরং সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কী ভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠা যায় সেই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন তাঁরা। ভাবলে গর্ব হয় শম্ভু মিত্র, সত্যজিৎ রায় আমার স্কুলের ছাত্র।

আমার প্রথম নাটক দেখা স্কুলেই। খুব ছোট তখন। নাটক হচ্ছিল অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শের আফগান’। মা’র হাত ধরে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি একেবারেই ধূসর। শুধু মনে আছে, একটা বিরাট মানুষ হাত দিয়ে মোমবাতি নেভাচ্ছিল। নাটকের প্রতি আকর্ষণও ওই স্কুল থেকেই। তুষার দে নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। আমার নাটকের হাতেখড়ি ওই তুষারবাবুর কাছেই। ‘অথ শিক্ষা বিচিত্রা’ নামে একটা নাটক করেছিলাম মনে আছে। তুষারবাবুরই লেখা। পরবর্তী কালে ‘চার্বাক’ নাট্যগোষ্ঠী নাটকটি করে। শুধু নাটকই নয়, রাজনীতির হাতে- খড়িও ওই স্কুল থেকেই। তুষারবাবুর কাছেই। নকশাল পার্টি করতেন ভদ্রলোক। জেলেও ছিলেন বেশ কিছু দিন। সেই সবই অদ্ভুত এক মায়ায় জড়ানো ছিল। ১৯৭৭ সালে যখন ইন্দির গাঁধীর পরাজয় হল, তখন আমি ক্লাস সেভেন-এ। সেই সময়টাও ছিল বদলের। বদল আমার শহরের, শহরের রাজনীতির, এমনকী আমারও। বামপন্থী রাজনীতির উত্থান প্রত্যক্ষ করছে তখন শহর। আমিও বড় হচ্ছি সেই মতাদর্শেই। ক্লাস ইলেভেনে হেরম্বচন্দ্র কলেজে চলে যাই শুধু মাত্র বাম রাজনীতি করার জন্যেই।

Advertisement

শহরের বদলের কথা বলছিলাম। রাজনীতিতে তো বটেই, আঙ্গিকে অবয়বেও তখন বদলাচ্ছে কলকাতা। আগে ৩১ নং বাসে করে স্কুলে যেতাম। সেই সময় থেকেই প্রাইভেট বাস চালু হল। ধুলো ধোঁয়ায় ব্যস্ততা বাড়ল শহরের। রেডিওর জায়গা নিতে শুরু করল সাদা-কালো টিভি। ছাদে ছাদে অ্যান্টেনার ভিড়। শহরের পেট চিরে মেট্রো রেলের প্রস্তুতি পর্ব, আগমনি পর্ব শুরু হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কী, সেই প্রথম সরাসরি শহরটাকে বদলে যেতে দেখলাম। পরিচিত শান্ত নির্ঝঞ্জাট শহরটা যেন রাতারাতি বদলে গেল। ট্রাম চলাচল বন্ধ হল। প্যাঁচপেঁচে কাদা আর যানজটে তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সবার। এরই মধ্যে আমার কাছে বেড়ে চলেছে শহরের গণ্ডি। আগে শুধু হাজরা মোড় অবধিই মোটামুটি আমার শহরের সীমা ছিল। কলেজে ওঠার পর সেটা বেড়ে যায় স্বাভাবিক ভাবেই। তখন কলেজের জি এস আমিই। প্রচুর নাটক করছি। মৃণ্ময় সেনগুপ্তর ‘অচেনা’ গোষ্ঠীতে তো করছিই—সেই সঙ্গে কলেজেও নাটক করছি চুটিয়ে, বাইরে যাচ্ছি নাটক নিয়ে, শ্যামবাজার যাচ্ছি নাটকের মিউজিক করতে, অ্যাকাডেমির সামনে রাত জেগে নান্দীকার ফেস্টিভালের টিকিট কাটা—সব মিলিয়ে নানা রং-বেরঙের পাখনা মেলে শহর তখন উড়ে বেড়াচ্ছে আমার সত্তা জুড়ে! একে একে কত বদল দেখলাম। রবীন্দ্রসদনের কাউন্টার বদলে গেল। বাস চলল অ্যাকাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে। বদলালাম আমিও। আমার মতাদর্শ বদলালো।

১৯৮৫-৮৬ নাগাদ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে আমার। আমাদের কলেজের মাস্টারমশাই অরিজিৎ মিত্রর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে তখন। ভদ্রলোক নকশাল রাজনীতি করতেন। বামপন্থী রাজনীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন ভিড় করছে তখন মাথায়। নকশাল পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। অদ্ভুত এক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে ছিলাম সে সময়টা। ‘বাবলি’ বা ‘আগুনের বর্ণমালা’র পরিচালকের জন্ম হয়তো সেই সময়টাতেই হয়ে গিয়েছিল।

আমার বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলাতে দেখেছি শহরটাকে। নব্বইয়ের দশকে হুড়মুড়িয়ে বদলে যেতে থাকল আমার অতি-পরিচিত কলকাতা। একে একে পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকল বহুতল। যার গালভরা নাম ফ্ল্যাটবাড়ি। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকেই একটা বহু পুরনো বাড়ি ছিল। বিরাট বাড়ি। বহু পরিবার থাকত সেখানে। একদিন ভাঙা হল সেই বাড়িটাও। বাস্তুহারা হল বহু দিনের পরিচিত মানুষগুলো। কোথায় যে গেল কে জানে। কষ্ট পেয়েছিলাম সে দিন। সল্টলেক উপনগরী পর্যন্ত বিস্তার ছড়িয়ে দেওয়া কলকাতা—তিলোত্তমা মহানগরী কলকাতা পরিণত হল অনেক, ব্যস্ত হল আরও বেশি—কিন্তু কোথাও যেন একটা অপরিচয়ের চাদরে আড়াল করে নিল নিজেকে। অন্তত আমার কাছে তো বটেই। দুর্গাপুজোটাও আর আগের মতো রইল না। সারা রাত জেগে ঠাকুর দেখতাম যে সব প্যান্ডেলে, ’৯৭-’৯৮ সাল থেকেই থিম পুজোর হিড়িক পড়ল সেখানে। সাবেকি পুজোগুলো একটা-দুটো করে হারিয়ে গেল কোথায়। সাবেকি মানুষগুলোও। আর আমি সাক্ষী থাকলাম এই বদলের বায়োস্কোপের। এখন সত্যি বলতে কী, কলকাতার সবটুকু আমি চিনিই না। দক্ষিণে সেই গড়িয়া, বাঁশদ্রোণী, উত্তরে দমদম ছাড়িয়েও আরও খানিকটা, রাজারহাট-নিউটাউন.. কত ছড়িয়ে গেছে কলকাতা! কত বিচিত্র তার জৌলুস। তবে আমার কাছে কিন্তু সেই মারাদোনার বিশ্বকাপ জেতার পরে যে-উৎসবের শহর, সেই কলকাতা আজও অমলিন। তার চেয়ে বেশি জৌলুস অন্তত আমার চোখে কলকাতার কোনও দিনও হবে না। খিদিরপুরের সেই ছোট ছেলেটার কাছে কলকাতা সেই কলকাতাতেই আছে।

লেখক: অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন