মেরুদণ্ড কিংবা স্নায়ুর অস্ত্রোপচার সফল হওয়ার পরে বাড়ি নয়, সরাসরি থেরাপি সেন্টারে পাঠিয়ে দেবে হাসপাতাল।
স্নায়ুর চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার সফল হলেও পরবর্তী থেরাপি না হওয়ায় অধিকাংশ রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে নতুন সেন্টারের পরিকল্পনা নিয়েছে এসএসকেএম হাসপাতাল। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানকার স্নায়ু বিভাগ কিংবা বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে (বিআইএন) স্নায়ুর অস্ত্রোপচারের পরে রোগীকে পাঠানো হবে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে। অস্ত্রোপচার পরবর্তী কী ধরনের থেরাপি রোগীর প্রয়োজন, তা জানিয়ে দেবেন চিকিৎসকেরা। প্রয়োজনে রোগীকে ভর্তি করে দ্বিতীয় পর্যায়ের চিকিৎসাও শুরু হবে।
বিশেষজ্ঞেরা জানান, স্নায়ুর চিকিৎসায় রিহ্যাবিলিটেশন কিংবা পুনর্বাসন অত্যন্ত জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার সফল হলেও পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসা ঠিকমতো না হওয়ার জেরে রোগীদের ভুগতে হয়। কোথায় স্নায়ুর থেরাপি হয়, কী ভাবে সেখানে পরিষেবা পাওয়া যাবে, এ নিয়ে ধোঁয়াশায় থাকে রোগীর পরিবার। সেই সমস্যা কাটাতে এসএসকেএমের এই নতুন নিউরো রিহ্যাব পরিকল্পনা রোগীকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে অনেকটাই সাহায্য করবে বলে মত চিকিৎসকদের একাংশের। এ প্রসঙ্গে স্নায়ু শল্য চিকিৎসক জে কে প্রুস্তি বলেন, ‘‘স্নায়ুর চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার প্রাথমিক পর্ব। রোগীর সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া নির্ভর করে অস্ত্রোপচার পরবর্তী থেরাপির উপরে। রাজ্যে সেই থেরাপির সুযোগ কম। সরকারি স্তর উদ্যোগী হলে রোগীদের আরও সুবিধা হবে।’’
এসএসকেএমের রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক জানান, ইতিমধ্যেই নিউরো থেরাপির সমস্ত পরিকাঠামো হাসপাতালে রয়েছে। স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপির পাশাপাশি বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে রোগীর সাইকো থেরাপি ও পুষ্টির দিকে। তিনি বলেন, ‘‘স্নায়ুর সমস্যায় রোগী অনেক সময়ে মানসিক জোর হারিয়ে ফেলেন। তাই পুনর্বাসন পর্বে সাইকো থেরাপি গুরুত্বপূর্ণ।’’ পাশাপাশি তিনি জানান, স্নায়ুর সমস্যায় আক্রান্তদের অধিকাংশ সব সময়ে শুয়ে থাকেন। ফলে তাঁদের পেশিশক্তি কমতে থাকে। এক সপ্তাহ টানা শুয়ে থাকলে, ১ শতাংশ পেশির শক্তি কমে। তাই থেরাপির প্রথম থেকেই রোগীর পুষ্টির দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। এসএসকেএমের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘স্নায়ুর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা বিআইএন-এ রয়েছে। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়। সম্পূর্ণ নিউরো থেরাপির চাহিদা অনেক। তাই সে দিকে গুরুত্ব দিয়েই দ্রুত নিউরো থেরাপির সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থার পরিকল্পনা হচ্ছে।’’
সরকারি স্তরে অস্ত্রোপচার পরবর্তী চিকিৎসা নিয়ে এই তৎপরতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলেই মনে করছে রাজ্যের চিকিৎসক মহল। যদিও এসএসকেএমের রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে মাত্র ৩০টি শয্যা রয়েছে। চাহিদার তুলনায় যা পর্যাপ্ত নয়। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক বলেন, ‘‘রাজ্যে যা চাহিদা রয়েছে, সেখানে পৃথক রিহ্যাবিলিটেশন হাসপাতালও হয়তো পর্যাপ্ত হবে না। তবে সরকারি স্তর থেকে রোগীদের এ বিষয়ে জানানোর উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ।’’
চিকিৎসকদের একাংশের চিন্তা, এসএসকেএম নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন নিয়ে পরিকল্পনা করলেও সার্বিক ক্ষেত্রে পুনর্বাসন এখনও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে না। এনআরএস, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতো একাধিক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্নায়ু বিভাগে নিয়মিত অস্ত্রোপচার হলেও থেরাপির কোনও ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর পরিজনেরা উদ্যোগী হয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের বিপুল খরচের বোঝা অনেকেই টানতে পারেন না।
অস্ত্রোপচারের পরে কেন সমস্ত সরকারি হাসপাতালে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাখা হয় না? এ প্রসঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, ‘‘নতুন দায়িত্বে এসেছি। রিহ্যাবিলিটেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ নিয়ে আলোচনা হবে।’’
নিউরো-রিহ্যাবিলিটেশন কী?
স্নায়ুর অস্ত্রোপচার সফল হওয়ার পরে চিকিৎসার দ্বিতীয় পর্ব হল রিহ্যাবিলিটেশন। বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে স্নায়ুকে ফের সক্রিয় করা হয়। ফিজিও, অকুপেশনাল, স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন পেশিকে ফের সক্রিয় করা হয়। সঙ্গে চলে রোগীকে মানসিক ভাবেও সক্রিয় করার প্রক্রিয়া। স্নায়ুর সমস্যায় রোগীর শারীরিক ক্ষমতা কমার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। থেরাপির মাধ্যমে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকেই চিকিৎসার পরিভাষায় নিউরো-রিহ্যাবিলিটেশন বলা হয়।