প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড

এসেছে বহু বদল, তবু এখানেই সুখের সন্ধান

কিছু সম্পর্ক, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার পাড়া। বাড়ির ঠিকানা যোধপুর পার্ক হলেও, পা়ড়া মানে কিন্তু প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড। গত পঁত্রিশ বছর ধরে আমার জীবনে নানা ভাবে জড়িয়ে আছে বৃহত্তর এই পাড়াটির প্রভাব।

Advertisement

অভিজিৎ সেন

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৫৮
Share:

সুমন বল্লভ

কিছু সম্পর্ক, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার পাড়া। বাড়ির ঠিকানা যোধপুর পার্ক হলেও, পা়ড়া মানে কিন্তু প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড। গত পঁত্রিশ বছর ধরে আমার জীবনে নানা ভাবে জড়িয়ে আছে বৃহত্তর এই পাড়াটির প্রভাব। হ্যাঁ, আনোয়ার শাহ রোডকে আমি এক বৃহত্তর পাড়াই বলব যার আনাচ-কানাচে মিশে আছে জীবনযাপনের বৈচিত্র আর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।

Advertisement

এখানে বসবাস করতে করতে সঞ্চয়ের ঝুলি ভরেছে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতায়। সেই অভিজ্ঞতায় জড়িয়ে আছে সম্পর্কের উষ্ণতা, নির্ভরতা আর টান। ঠিক যেমনটা আত্মীয়দের সঙ্গে হয়ে থাকে। দেশপ্রাণ শাসমল রোড থেকে শুরু হয়ে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড যাদবপুর থানার সামনে মিশেছে রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক রোডে।

আজকের আনোয়ার শাহ রোড মানেই নিত্য যানজট, অবিরাম যান চলাচল, আর আলো ঝলমলে অসংখ্য দোকান। তারই মাঝে রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য ঝাঁ-চকচকে বহুতল, অভিজাত শপিংমল আর রেস্তোরাঁ। এখন বেশির ভাগ বহুতলের নীচে তৈরি হয়েছে দোকান। তাই আস্তে আস্তে এখানেও বেড়ছে বাণিজ্যিক প্রভাব। অনেক জায়গায় চোখে পড়ে বড় বড় হোর্ডিং।

Advertisement

এক সময়ে রাস্তার দু’ধারে ছিল অসংখ্য বাগানওয়ালা একতলা, দোতলা বাড়ি। একে একে সেগুলি হারিয়ে গেল। পরিবর্তে তৈরি হল বহুতল। আজ ক’টা বাড়ি আছে হয়তো হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। এরই সঙ্গে বাড়তে থাকা জমির দাম ও ফ্ল্যাটের দামের জন্য বাঙালিদের চেয়ে অবাঙালিদের সংখ্যা একটু একটু করে বাড়ছে। সময়ের পরিবর্তনকে মেনে নিলে আমাদের এই পাড়াটা শান্তিপূর্ণ, রয়েছে সকলের মধ্যে সম্প্রীতি। পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে আজও রয়েছে সুসম্পর্ক আর যোগাযোগ।

আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে এখানকার নাগরিক পরিষেবা। বসেছে জোরালো আলো, নিয়মিত হয় রাস্তা পরিষ্কার। আগে আনোয়ার শাহ রোড সংলগ্ন বেশ কিছু রাস্তায় জল জমলেও এখন সেই সমস্যা অনেকটাই কমেছে। তবে রাস্তার উপরে এখনও কয়েকটি খোলা ভ্যাট থাকায় এক দিকে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ায়, তেমনই দৃশ্য দূষণও হয়। জানি না এ ছবিটা বদলাবে কবে?

কাছেই রয়েছে একটি বড় মল আর আকাশ ছোঁয়া বহুতলের সারি। বিকিকিনির সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে যানজট, আর মানুষের ভিড়। বিশেষ করে শনি, রবিবার সন্ধ্যায় ওই এলাকা দিয়ে হাঁটা-চলা কারাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। তেমনই বদলেছে লর্ডস-এর মোড়ের ছবিটাও। এখন সেখানে অসংখ্য খাবার দোকান। ফুড হাব বললেও খুব একটা ভুল হবে না।

অন্যান্য পাড়ায় খেলাধুলোর পরিবেশ কমলেও এ পাড়ার ধার ঘেঁষা তালতলা মাঠে এলাকার ছোটদের যেমন খেলতে দেখা যায় তেমনই কাছাকাছির স্কুলগুলিও মাঠে খেলতে আসে। তবে এই মাঠটির আরও এক আকর্ষণ বিভিন্ন মেলা। দক্ষিণ কলকাতায় যখন মেলার সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তখন এই মাঠে বছরে বেশ কয়েকটি মেলা হওয়ায় উৎসবের আমেজ মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায়।

আগের তুলনায় কমলেও আজও আনোয়ার শাহ রোডের ধারে বেশ কিছু বাঁধানো গাছতলায় চোখে পড়ে প্রবীণ ও মাঝ-বয়সীদের আড্ডা। এ ছাড়াও আড্ডার ছবি ধরা পড়ে শহিদ সূর্য সেন ভবনের সামনে। এলাকার কিছু ক্লাবের উদ্যোগে হয় স্বাস্থ্য ও চক্ষু পরীক্ষা শিবির। পাড়াতেই রয়েছে অরবিন্দ সেবা কেন্দ্র।

কাছেই তালতলা মাঠের দুর্গাপুজোয় প্রতি বছরই থাকে নতুনত্বের ছোঁয়া। আর কাছাকাছির মধ্যে যোধপুর পার্কের কয়েকটি পুজোও উল্লেখ্য। থিমের জাদুতে প্রতি বছরই চমক থাকায় ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। তবে পুজোর পাশাপাশি এ অঞ্চলের ইদ, মহররমও বর্ণময়। কাছাকাছির বাজার বলতে যোধপুর পার্ক বাজার আর লর্ডস-এর মোড়ের বাজারটিতে সব কিছুরই দাম মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। আজও আছে ক্রেতা-বিক্রেতার আন্তরিক সম্পর্ক।

আজ এ পাড়ায় হাঁটলেই চোখে পড়ে বদলে যাওয়া সময়ের প্রতিচ্ছবি। এ পাড়ার অতীত আর বর্তমান যেন দুই জগৎ। মনে পড়ে সাতের দশকের শেষ দিকে আনোয়ার শাহ রোড ছিল একটি সঙ্কীর্ণ রাস্তা। এক ঘণ্টায় হয়তো একটি মাত্র বাস চোখে পড়ত। শহরের অন্যত্র পৌঁছনোর জন্য যেতে হত আনোয়ার শাহ রোডের মোড় কিংবা যাদবপুর থানায়।

এই আনোয়ার শাহ রোডে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। মাঝেমধ্যেই দেখি শিল্পপ্রেমিক বিদেশিরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। রাস্তাটির সঙ্গে জড়িয়ে টিপু সুলতানের পরিবারের ঐতিহ্য। মনে পড়ে তাঁর পরিবারের এক সদস্য দারুণ বিরিয়ানি রাঁধতেন। উৎসবে, অনুষ্ঠানে কত বার তিনি এসে রান্না করেছেন। সেই স্বাদ আজও জিভে জল আনে। টিপুর পরিবারের সদস্যদের সেই পুরনো বাড়িটিও আজ নেই। সেখানেও মাথা তুলেছে বহুতল।

অনেক বদলালেও নিজের অজান্তেই জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে এ পাড়াটা। হয়তো একেই বলে টান। সে যা-ই হোক, এ পাড়া ছেড়ে অন্যত্র যাচ্ছি না! এখানেই তো পেয়েছি সুখের সন্ধান।

লেখক বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন