গাড়ি-বারান্দা এ ভাবেই ঢুকে গিয়েছে উড়ালপুলের নীচে।ছবি:দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
সেতু তৈরির সময়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন এলাকার কয়েক জন। বিবেকানন্দ উড়ালপুল বিপর্যয়ে সেতুর তলার গাড়ি-বারান্দা ভেঙে নীচে থাকা একাধিক জন চাপা পড়ে মারা যাওয়া তাঁদের আশঙ্কাকে সত্যি করেছে। বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে উদ্বেগ। ওই উড়ালপুলের নির্মাণপথে থাকা এমন আরও কয়েকটি গাড়ি-বারান্দা যে একেবারেই বিপন্মুক্ত নয়, এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কলকাতা পুরসভাও। ওই ঘটনার পরে এ বার ফুটপাথের উপরে থাকা গাড়ি-বারান্দা রাখা আদৌ উচিত কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে পুর-মহলে। প্রশ্ন উঠেছে, উড়ালপুল তৈরির সময়ে তা যে একেবারে গাড়ি-বারান্দার উপর দিয়ে যাবে, সে কথা মাথায় রাখা হয়নি কেন? কেনই বা ওই ধরনের গাড়িবারান্দা রেখে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে পুরসভা?
পুর-কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ১৯৮০ সালের নতুন পুর-আইন মোতাবেক শহরের কোথাও গাড়ি-বারান্দা বানানো নিষেধ। কিন্তু উত্তর কলকাতার বেশ কিছু এলাকায় ওই ধরনের গাড়ি-বারান্দা রয়ে গিয়েছে। যার কয়েকটির হালও বেশ খারাপ। পুরসভার বিল্ডিং দফতরের এক অফিসার জানান, ওই ধরনের বহু গাড়ি-বারান্দা তৎকালীন পুর-কতৃর্পক্ষের অনুমতি নিয়েই গড়া। পুরসভার শিডিউল ১৬ অনুসারে গাড়ি-বারান্দা গড়ার অনুমতি দেওয়া হতো। ১৯৮০ সালের সংশোধিত পুর-আইনে গাড়ি-বারান্দা তৈরিতে নিয়ন্ত্রণ জারি হয়। ফলে তার আগে তৈরি এই বারান্দাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও ক্ষমতা এখনকার পুর-বোর্ডের নেই। এমন বেশ কয়েকটি গাড়ি-বারান্দায় আবার ঘরও বানানো হয়েছে। সেই ঘরগুলি কেন ভাঙা হয়নি, তার কোনও জবাব অবশ্য মেলেনি।
কিন্তু বিপর্যয় ঘটলে পুরসভার ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠবেই, তা বিলক্ষণ বোঝেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তবে তাঁরও বক্তব্য, ‘‘অনেক আগে পুরসভার অনুমোদন নিয়েই ওই সব গাড়ি-বারান্দা গড়া হয়েছে। তাই কিছু করার নেই।’’
আইনের যুক্তি যা-ই হোক, উড়ালপুলের কাঠামো তৈরির সময়েই দেখা গিয়েছে, বেশ কিছু গাড়ি-বারান্দা ঢুকে পড়েছে নির্মীয়মাণ সেতুর নীচে। ফলে যে কারণে গাড়ি-বারান্দা বানানো হয়েছিল, তার কোনও সুবিধাই এখন নেই। বরং ঝুঁকির দিকটাই বেশি। যা আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনায়। কারণ ভেঙে পড়া সেতুর চাপে নীচে থাকা জোড়াসাঁকো কালীমন্দিরের সামনের গাড়ি-বারান্দাটিও ভেঙে পড়েছে।
পুর-প্রশাসকেরাই মানছেন, নেহাত বরাত ভাল বলে ভয়াবহ ওই ঘটনার আঁচ পড়েনি মন্দির এবং উড়ালপুলের নির্মাণপথে ৯ ও ১২ নম্বর বিবেকানন্দ রোডের ঠিকানায় থাকা গাড়ি-বারান্দাগুলিতে। শুধু সেতুর চাপ নয়, একাধিক গাড়ি-বারান্দার হালও ভেঙেচুরে সঙ্গীন। মানিকতলা মোড় থেকে জোড়াসাঁকো কালীবাড়ির মধ্যে বিবেকানন্দ রোড জুড়ে গোটা ২০ এ রকমই ভয়ঙ্কর গাড়ি-বারান্দা রয়েছে। ২৪০ বিবেকানন্দ রোডের গাড়ি-বারান্দাটি যেমন বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, এই বুঝি ভেঙে পড়ল! মানিকতলা মোড়ের কাছে ডান দিকে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের মুখে বহু পুরনো তিনতলা বাড়ি। ফুটপাথের উপরে গাড়ি-বারান্দার স্তম্ভগুলি ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীর্ণ হয়ে রয়েছে। বাড়ির নীচের তলায় একটি বইয়ের দোকান। দোকানের মালিক বলেন, ‘‘প্রতিদিন প্রাণ হাতে নিয়ে দোকান খুলি।’’ পুরসভা কেবল ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ লেখা নোটিস টাঙিয়েই দায় সেরেছে। পাশেই উল্টোডাঙা ট্রাফিক পুলিশের ৩৬ নম্বর বিট। কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘যে কোনও দিন ভেঙে পড়তে গাড়ি-বারান্দা সমেত পুরো বাড়ি। পুরসভাকে জানিয়েও লাভ হয়নি।’’
এখন কী করণীয়, তা ভেবে পাচ্ছেন না পুর-আধিকারিকেরাও। তাঁদের আশঙ্কা, ফুটপাথের উপরে ছাউনির মতো থাকা ওই গাড়ি-বারান্দার নীচে অনেকে আশ্রয় নেন। থাকে ছোটখাটো দোকানও। ফলে বিবেকানন্দ উড়ালপুলের মতো বিপর্যয়ে একই ধরনের পরিণতি হতেই পারে।
অথচ উড়ালপুল নির্মাণ শুরুর সময়েই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা। বিবেকানন্দ রোডের এক বাসিন্দা রতন সাহা বলেন, ‘‘আমার বাড়ির ছাদের পাশ দিয়েই সেতুর কাজ হতে দেখে আপত্তি জানিয়েছিলাম, কেউ কান দেয়নি।’’ ৯ নম্বর বিবেকানন্দ রোডের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘গাড়ি-বারান্দা তো চাপা পড়ে গিয়েছে সেতুর নীচে। প্রতিবাদ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি।’’
বিবেকানন্দ উড়ালপুলের নির্মাণপথে থাকা ওই গাড়ি-বারান্দার উপর দিয়ে সেতু নিয়ে যাওয়া যে যুক্তিসঙ্গত হয়নি, তা মেনে নিয়েছেন পুরকর্তারাও। তাঁরা জানান, যে ভাবে গাড়ি-বারান্দার উপর দিয়ে সেতু চলে গিয়েছে, তা সব সময়ে ঝুঁকির এবং আতঙ্কেরও বটে। সেতুর নকশা তৈরির সময় বিষয়টি নজরে রাখা উচিত ছিল বলে মনে করছেন পুরসভার একাধিক অফিসারও। তাঁদের কথায়, সেতু গড়ার আগে এ ভাবে কাজ করার জন্য পুর-প্রশাসনের আপত্তি তোলা জরুরি ছিল।
কিন্তু উড়ালপুলের নকশা তৈরির সময়ে কেন গাড়ি-বারান্দার উপর দিয়ে সেতু নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি তোলেনি পুরসভা? জবাব মেলেনি।
বিবেকানন্দ উড়ালপুলের নকশা হয়েছিল বাম আমলে। সে সময়ে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এলাকার প্রাক্তন সাংসদ, সিপিএমের সুধাংশু শীলের। তিনি জানান, উড়ালপুলের নকশা তৈরির সময়েই নির্মাণপথে কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দেখা হয়। তা উড়ালপুলের উপরে-নীচে এবং দু’দিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ ছাড়াও নীচে নিকাশি এবং জলের লাইন সরবরাহ ঠিক করে কাজ করতে হয়। সে সময়ে পুরসভার রেকর্ডে যা ছিল, তার ভিত্তিতেই সেতুর নকশা হয়েছে।
বিপজ্জনক এই গাড়ি-বারান্দাগুলি কি তখন দেখা হয়নি? সুধাংশুবাবু বলেন, ‘‘এমন কিছু গাড়ি-বারান্দা আছে, যেগুলি এত পুরনো যে, পুর-রেকর্ডেই নেই। একাধিক ক্ষেত্রে অবৈধ নির্মাণ হওয়াতেও সমস্যা বেড়েছে।’’
যুক্তি, তর্ক যা-ই থাক, মাথায় বিপদ নিয়েই যাঁদের দিন কাটছে, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও দিশা মেলেনি কোনও তরফেই।