কল্যাণের ব্রত আঁকড়েই বেঁচে আছেন মাস্টারমশাই

কল্যাণব্রত দাস। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। সর্বক্ষণের পোশাক বলতে পাঞ্জাবি আর পাজামা। চোখে মোটা কাচের চশমা। চশমার বাঁ দিকের ডাঁটিটা অবশ্য ভাঙা। বছর সত্তরের এই বৃদ্ধকেই ইএম বাইপাস লাগোয়া কাদাপাড়া বস্তির বাসিন্দারা এক ডাকে চেনেন মাস্টারমশাই নামে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০০:১৩
Share:

উদ্যোগী: বাইপাস লাগোয়া কাদাপাড়ায় বাগান পরিষ্কার করতে ব্যস্ত কল্যাণব্রত দাস। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

খালি গা, খালি পা। মাস্টারমশাইয়ের বাগানে যাওয়ার গলিপথ চিনিয়ে নিয়ে চলেছে এক খুদে। মাস্টারও রয়েছেন। তবে বয়সের ভারে একটু পিছিয়ে পড়েছেন। রাস্তার একটি বাঁক ঘুরতেই ‘এক মিনিট দাঁড়ান’ বলে মাটিতে ঝুঁকে পড়ে ময়লার স্তূপ ঘাঁটতে শুরু করলেন বৃদ্ধ। পড়ে থাকা বেলের খোলের মধ্যে আধখাওয়া বেলের অংশ বেছে বেছে তুলে নিয়ে বললেন, ‘‘পুঁতলে গাছ হবে। অনেক বীজ রয়েছে।’’ বাঁ হাতে চশমা ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘চলুন, আমার বাগান দেখাই!’’ সঙ্গী খুদেকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘কই, নিয়ে চল!’’

Advertisement

কল্যাণব্রত দাস। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। সর্বক্ষণের পোশাক বলতে পাঞ্জাবি আর পাজামা। চোখে মোটা কাচের চশমা। চশমার বাঁ দিকের ডাঁটিটা অবশ্য ভাঙা। বছর সত্তরের এই বৃদ্ধকেই ইএম বাইপাস লাগোয়া কাদাপাড়া বস্তির বাসিন্দারা এক ডাকে চেনেন মাস্টারমশাই নামে। বস্তির আড়াইশো ঘর সাফাইকর্মীর ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব তাঁর উপরেই। নিজের ওই পড়ুয়াদের নিয়েই সুভাষ সরোবর লাগোয়া কাদাপাড়ায় রাস্তার এক ধারে বাগান তৈরি করেছেন বৃদ্ধ। মাস্টারমশাইয়ের নির্দেশে প্রতিদিন সকালে বাগান পরিচর্যায় সময় দেওয়াটা পড়ুয়াদের জন্য বাধ্যতামূলক! তিনি স্কুল এবং এই বাগানের নাম দিয়েছেন ‘বিদ্যাসাগর পাঠাগার ও পাঠ উদ্যান’। সগর্বে দাবি করেন, ‘‘আমার বাগানে সব গাছ পাবেন। আমার ছাত্রছাত্রীরা শুধু পড়াশোনায় নয়, উদ্ভিদ বিজ্ঞানেও পারদর্শী।’’

প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টায় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাগানে হাজির হন কল্যাণব্রতবাবু। ঘণ্টাখানেক গাছপালার পরিচর্যার পরে বস্তির ক্লাবের চাতালে শুরু হয় ‘স্কুল’। দুপুরে পড়ুয়াদের বিদায় দিয়ে বস্তির ঘরে ঘরে ঘোরা শুরু করেন কল্যাণব্রতবাবু। কেউ অসুস্থ থাকলে তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা করানো, প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, নানা রকমের ফর্ম পূরণ করে দেওয়া— মাস্টারমশাইয়ের কাজের অভাব নেই!

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কল্যাণব্রতবাবু অবশ্য জানাচ্ছেন, তাঁর এই কাজের শুরু ছোটবেলায় মেদিনীপুরের গ্রামে থাকাকালীনই। সেখানে বন্ধুদের নিয়ে একটি ক্লাব তৈরি করে ‘এভরি ইঞ্চি প্রোগ্রাম’ শুরু করেন। কল্যাণব্রতবাবুর কথায়, ‘‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের লোককে বোঝাতাম যে, কোনও জায়গাই ফেলে রাখার নয়। জমি ফেলে রাখার পরিবর্তে গাছ লাগানোর কথা বলতাম আমরা। বাদাম গাছ লাগালে বাদাম খাবে, আবার খোসাও কাজে লাগাতে পারবে।’’ শহরে পড়তে এসেও ওই ভাবনাকে ছেড়ে দিতে পারেননি কল্যাণব্রতবাবু।

আনন্দমোহন কলেজে পড়াকালীন কাদাপাড়া এলাকায় ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বস্তির এই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাব বলে এখানেই ঘর ভাড়া নিলাম। সুভাষ সরোবরের গাছের নীচে একটা স্কুল করলাম।’’ পুরনো ক্যারম বোর্ডে আলকাতরা মাখিয়ে বানানো হল ব্ল্যাক বোর্ড। প্লাস্টার অব প্যারিস জমিয়ে তৈরি করা হল চক। সয়াবিন পিষে বার করা তরল খেতে দেওয়া হত ছাত্রদের। প্রথম দিকে সেই স্কুলের সাফল্য দেখে সরকারি সাহায্যেরও আশ্বাস আসতে শুরু করে। তবে সে পথে হাঁটেননি মাস্টারমশাই। বলছেন, ‘‘দশটা-পাঁচটার স্কুল করব না বলেই ঠিক করেছিলাম। সরকারি সাহায্য নিলে আমি যেমন স্কুল করতে চেয়েছিলাম, তা থাকত না।’’ একার চেষ্টার সেই স্কুল অবশ্য বেশি দিন চালাতে পারেননি কল্যাণব্রতবাবু। সুভাষ সরোবর লাগোয়া রাস্তা সম্প্রসারণের সময়ে স্কুল ভাঙা পড়ে। ভেঙে দেওয়া হয় সেই সময়ে তাঁর বানানো বাগানও।

পরে সুভাষ সরোবরের ধারে বস্তির একটি ঘরে দেড় হাজার ফুলের টব বসিয়ে একটি নার্সারি বানিয়েছিলেন। সম্প্রতি সল্টলেক স্টেডিয়ামে হয়ে যাওয়া অনূর্ধ্ব ১৭ ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ে সেই ঘরও ভাঙা পড়ে। গত বছরের শেষ দিকে স্ত্রী শিবানীর মৃত্যু হয়। কল্যাণব্রতবাবু নিজেও এখন অসুস্থ। পিঠে টিউমার হয়েছে এবং পেটে পাথর জমেছে। মায়ের মৃত্যুর পরে বিবাহিত দুই মেয়ে প্রতিশ্রুতি এবং অরুন্ধতী অসুস্থ বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। কাদাপাড়ার বস্তিতেই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই থেকে গিয়েছেন মাস্টারমশাই।

একদল বাচ্চাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘এদের ছেড়ে যাব কোথায়? মাস্টারমশাই ডাকটা শুনলেই মন ভাল হয়ে যায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন