বছরের পর বছর একাই থাকতেন চার-দেওয়ালের ঘেরাটোপে। দুই ছেলে থাকলেও বড় জনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মুম্বইয়ের বাসিন্দা ছোট ছেলে কখনও বছরে কিংবা দু’বছরে এক বার আসেন মাকে দেখতে।
এ ভাবে একা থাকতে থাকতে বন্ধ ঘরের ফ্ল্যাটে যখন মৃত্যুর মুখে ঢলে প়ড়লেন তখনও কাউকে কাছে পেলেন না। পরে তাঁর দেহ যখন উদ্ধার হল, তখন তাতে পচন ধরে পোকা ধরে গিয়েছিল। মাছি ভনভন করছিল। ঘটনাটি লেক থানার ১/২২৭ যোধপুর পার্কের। পুলিশ জানায়, মৃতার নাম অনুভা সেনগুপ্ত (৬৯)।
পুলিশ জানায়, ওই আবাসন থেকে তাদের কাছে একটি ফোন যায়। ফোনে বলা হয়, দুপুরের পর থেকে ওই আবাসনের চারতলার এক ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে পচা গন্ধ আসছে। পুলিশ গিয়ে ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে দেখতে পায় বাথরুমে বৃদ্ধার দেহ দেখতে পায়। পরে থানা থেকে লোক আনিয়ে সেই দেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয় এম আর বাঙুর হাসপাতালে। পুলিশের অনুমান, কয়েক দিন আগেই ওই বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর দেহে আঘাতের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলেই খবর।
পুলিশ জানায়, গত ১৬-১৭ বছর ধরে ওই আবাসনের চার তলার একটি ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন অনুভাদেবী। স্বামী সরোজ সেনগুপ্ত মারা গিয়েছেন বছর কুড়ির উপরে। দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে কোথায় থাকেন পুলিশকে কেউ বলতে পারেননি। তবে ছোট ছেলে থাকেন মুম্বইয়ে। আগে মাকে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন। কিন্তু কয়েক বছর হল অনুভাদেবী যেতেন না। আর ছেলে মুম্বই থেকে এলেও বছরে এক বার, কখনও দু’বছরে একবার আসতেন। কিন্তু অনুভাদেবীর ভাই থাকেন ওই আবাসনেরই দোতলায়। তিনি কেন কোনও খবর রাখতেন না?
অনুভাদেবীর ভাই অমিতাভ সেনের কথায়, ‘‘দিদি কারও সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। নিজের কোনও খবরও দিতেন না।’’ অনুভাদেবীর কাছে কোনও পরিচারিকাও থাকতেন না বলে জানিয়েছেন তাঁর ভাই। তা হলে তিনি নিজে কেন জোর করে দিদির খোঁজ নিতেন না? ওই প্রশ্নের উত্তরে অমিতাভবাবুর জবাব, ‘‘দিদি চাইতেন না।’’এই আবাসনেরই একটি অন্য ফ্ল্যাটে কাজ করেন এমন এক পরিচারিকা জানান, তিনি কয়েক বছর আগে বেশ কয়েক দিনের জন্য কাজ করেছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধা খুবই খিটখিটে বলে তিনি কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে বাধর্ক্য-বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর দাবি, যে কোনও মানুষই দিনের পর দিন একা থাকতে থাকতে খিটখিটে হয়ে যান। আর বয়স বাড়লে একাকিত্ব চেপে ধরে। তাঁর কথায়, ‘‘বয়স হলেই আমরা মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে একা করে দিই। বুঝি না তাঁকে সঙ্গ দেওয়া দরকার। এমনকী ছেলেমেয়েরাও তা বুঝতে চায় না। আর তাই এ ধরনের ঘটনার সাক্ষী হতে হয় আমাদের। এই ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’’
মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে দুই তরফেই সমস্যা থাকতে পারে। মা হয়তো সন্তানদের সঙ্গে তেমন নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি। ছেলেরাও হয়তো ব্যস্ততার মধ্যে মা-কে যে ভাবে দেখা দরকার, দেখেননি।’’