মরা গাঙে বান, বলছে যাত্রাপাড়া

সারা রাজ্য থেকে বাছাই করে আনা নতুন শিল্পীদের নিয়ে গত পনেরো দিন ধরে চলেছে প্রশিক্ষণ। শনিবার, রথের দিন ছিল বাগবাজারের ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রা মঞ্চে তারই চূড়ান্ত ফলপ্রকাশের অনুষ্ঠান। ‘ফুটবল’-এর পাশাপাশি আরও তিনটি পালা মঞ্চস্থ করলেন নতুনেরা।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৮ ০১:৫১
Share:

বুকিং-এর পর নায়কের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে রসিদ। নিজস্ব চিত্র

বাইরে, নীল-সাদা কাপড়ে বাঁধা হয়েছে পরপর বুকিং অফিস। মঞ্চের প্রবেশপথে নতুন পালার পোস্টার দিয়ে দেওয়াল জোড়া প্রদর্শনী। মূল মঞ্চে ঢোকার মুখে চলছে জগন্নাথের পুজো। ভিতরে তখন অন্য চমক। সম্মুখ সমরে ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়া। নীল এবং লাল-সাদা চেক গেঞ্জি পরা মুখগুলো চোখ আর পেশি ফুলিয়ে লড়াইয়ের ডাক দিচ্ছে। গান-বাজনা-আলো আর দর্শকের উল্লাসে যেন ২৪ ঘণ্টা আগেই চলে এসেছে বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের মাহেন্দ্রক্ষণ।

Advertisement

সারা রাজ্য থেকে বাছাই করে আনা নতুন শিল্পীদের নিয়ে গত পনেরো দিন ধরে চলেছে প্রশিক্ষণ। শনিবার, রথের দিন ছিল বাগবাজারের ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রা মঞ্চে তারই চূড়ান্ত ফলপ্রকাশের অনুষ্ঠান। ‘ফুটবল’-এর পাশাপাশি আরও তিনটি পালা মঞ্চস্থ করলেন নতুনেরা।

বাইরে যাত্রা মঞ্চের প্রায় দোরগোড়ায় তখন থেমেছে একটি রথ। তারই সামনে ভক্তের ভিড়। তা ঠেলে এগোতেই জানা গেল, কিছু ক্ষণ আগে মঞ্চে ঢুকেছেন পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা অ্যাকাডেমির সভাপতি, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। কাকতালীয় ভাবে দোরগোড়ায় এসে থামা রথ যেন হারানো সুদিন ফেরানোরই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বলছিলেন এক প্রবীণ যাত্রাশিল্পী।

Advertisement

গত চার বছর ধরে চলা এই প্রশিক্ষণ শিবির ছাড়াও যাত্রার উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ মৃতপ্রায় শিল্পে জোয়ার আনছে, এ দিনের অনুষ্ঠানে তেমনই শোনালেন যাত্রাশিল্পী ও কলাকুশলীরা। যেমন যাত্রা করার অনুমোদন পেতে যে টাকা লাগে, তা এখন কমেছে। একশো টাকা পর্যন্ত যাত্রার টিকিটে কর মকুব হয়েছে। রাজ্য জুড়ে চলছে নতুন অভিনেতার খোঁজ। দালালরাজ বন্ধ করতে পালা ও সংস্থার ফোন নম্বর দিয়ে গত বছর থেকে বেরোচ্ছে ‘যাত্রা দর্পণ’।

এ সবই যেন যাত্রার মরা গাঙে বান এনেছে। পায়ে পায়ে যাত্রাপাড়া ঘুরে তেমনই ইঙ্গিত মিলল। সোনার বাংলা যাত্রা সংস্থার প্রযোজক সঞ্জীব দলুই বললেন, ‘‘নতুন পালা, ‘তোমার সিঁদুরে আমার সোহাগ’-এর জন্য রথের দিনের প্রথম পাঁচ ঘণ্টায় ৪৫টি পালা বুক হয়ে গিয়েছে।’’ রাজলক্ষ্মী অপেরা, তাদের এ বছরের পালার জন্য নিয়ে আসছেন অভিনেতা হিরণকে। এ দিনের বুকিং দেখে আশায় বুক বাঁধছেন শ্রীচৈতন্য অপেরা প্রযোজিত ‘সংসার এক খেলাঘর’-এর নির্দেশক অভিনেত্রী রুমা দাশগুপ্ত।

রথযাত্রার বিকেলে রবীন্দ্র কাননের কাছের চিৎপুর ধরে হাঁটতেই নজর পড়ল যাত্রাপাড়ার ব্যস্ততা। রজনীগন্ধা ফুলের চেনে সেজেছে প্রতিটি অফিস। নতুন পালার জানান দিয়ে বড় পোস্টার, ছবি, আলো আর ফুলের গেটে সেজেছে সে সব। সে সাজই বলে দেয় যেন, সামান্য হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ শিল্প। নন্দকুমার থেকে বায়না করতে আসা এক ‘নায়েক’ (পালার বায়না করতে আসেন যাঁরা) পঁয়ষট্টি হাজার টাকার পালা এক হাজার এক টাকা দিয়ে বুক করে মেতে উঠলেন খোশগল্পে। অন্য ঘর থেকে আড় চোখে দেখে গেলেন এক কর্মচারী। ফিরে ম্যানেজারকে বললেন, ‘‘আগের বছরের খদ্দের তো ও ঘরে চলে গেল!’’ ম্যানেজারের মুখের ভাবই বলে দিল, তাঁদের শিল্পে এসেছে ‘অচ্ছে দিন’। ‘‘ঠিক আছে, আমরাও অন্য ঘর থেকে আনব।’’ হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন ম্যানেজার।

যাত্রাপাড়ায় ঘুরে বেড়ানো অভিজ্ঞ শিল্পীদের চোখ বলছে, এই রেষারেষিটাই আসল। পাশাপাশি ঘরের এই রেষারেষিই যে বলে দেয়, ক্লান্তিতে গতি কমলেও ঠিক ওষুধে চাঙ্গা হওয়ার আশা আছে দিব্যি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন